Skip to main content

চলে এসেছে স্বচ্ছ সৌর কোষঃ সাধারণ সোলার সেলের চেয়ে ১০০০ গুন বেশি কর্মক্ষম

বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন প্রায় স্বচ্ছ এক বিশেষ ধরনের সৌর কোষ বা সোলার সেল। নতুন উদ্ভাবিত এই স্বচ্ছ সোলার সেল সূর্যের আলো থেকে শক্তি উৎপাদন করতে সাধারণ সোলার সেলের চেয়ে ১০০০ গুন বেশি দক্ষ। 

গবেষকরা মনে করছেন, এই স্বচ্ছ সোলার সেল নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের ধারণাটাকেই বদলে দেবে, কারন এই সোলার সেল ব্যবহার করা যাবে জানালায়, গাড়িতে, এমনকি সব ধরনের যন্ত্রপাতিতেও। 

চলুন জেনে আসি বিস্তারিত...


নবায়নযোগ্য শক্তির তালিকায় সৌরশক্তির নামটা প্রথম দিকেই থাকবে, অথচ সাধারণ সোলার সেল তার আকার, দৃঢ়তা, আর অস্বচ্ছতার কারণে খুব বেশিদুর এগোতে পারে নি। এই সব বাধা বিপত্তির কারণে সৌরশক্তি এতোদিন ধরে আটকে ছিলো শুধুমাত্র বাড়ির ছাদে, কিংবা খোলা মাঠে।

এই সব বাধা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করতে বহুদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছিলেন অসংখ্য বিজ্ঞানী আর গবেষক। তারা চেষ্টা করছিলেন যাতে সহজে, কম খরচে একটা স্বচ্ছ সোলার সেল (Transparent Solar Cell) বা TSC তৈরি করা যায়। এটি করতে পারলে তারা অন্যান্য সব সারফেস থেকেও সৌরশক্তি সংগ্রহ করতে পারবেন।




সম্প্রতি গবেষকেরা বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন

এমন ধরনের TSC তৈরি করা সম্ভব হয়েছে যা কিনা জানালা, গাড়ি, কিংবা মানুষের চামড়াতেও বসানো যাবে এবং সেখানে থেকে সৌরশক্তি সংগ্রহ করতে পারবে।

সাধারণ সোলার সেল মোটামুটি মাত্রায় কাজ করলেও সেগুলো দেখতে তেমন একটা আকর্ষণীয় না। তাছাড়া এদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপাতির সাথেও সংযুক্ত করা যায় না।

অন্যদিকে, TSC কিংবা আরো উন্নত সংস্করণ হিসেবে প্রায়-অদৃশ্য সোলার সেল (Near-Invisible Solar Cells বা NISC) এইসব সমস্যা দূর করতে সক্ষম।

এসব NISCs প্রায় ৭০% থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ৭৯% পর্যন্ত স্বচ্ছতা (Average Visible Transparency -- AVT) সম্পন্ন হয়ে থাকে।

ফলে, এরা সৌরশক্তি সংগ্রহের পাশাপাশি চারপাশের পরিবেশের সাথে দারুণভাবে মিশে যেতে পারে।


এই অসাধ্য সাধন করা সম্ভব হয়েছে একটা বিশেষ টাইপের 2D পদার্থের মাধ্যমে, যাদের সাধারন নাম
Transition Metal Dichalcogenides বা TMD।

ভাবছেন পদার্থ আবার 2D হয় কিভাবে, তাই না?

আসলে কাহিনি হচ্ছে এসব পদার্থ এতই পাতলা যে তাদের পুরুত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। অভাবনীয় রকমের পাতলা হবার পাশাপাশি এসব পদার্থের আলোকরশ্মি শুষে নেবার ক্ষমতাও অসাধারণ।


এছাড়াও এদেরকে দৃশ্যমান আলোর যে কোন ব্যান্ড গ্যাপ শুষে নেবার মত করে কাস্টোমাইজও করে ফেলা যায়।

এই ধরনের 2D পদার্থের এসব বিশেষ গুন কাজে লাগিয়েই গবেষকেরা সোলার সেলের মধ্যে স্বচ্ছতা আর আলোকরশ্মি শুষে তা থেকে সৌরশক্তি উৎপন্ন করার ক্ষমতা নিয়ে এসেছেন, আগেকার দিনের সাধারণ সোলার সেলের মধ্যে যে ক্ষমতা ছিলো না। এসবের পেছনের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সের অভাবনীয় অগ্রগতি।



TMD’র ওপর ভিত্তি করে বানানো NISC এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে বিজ্ঞানীরা দুই ধরনের পদার্থ কিভাবে নিজেদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখায় সেটা নিয়ে গবেষণা করেন।


পদার্থ দুটির একটি হচ্ছে ইনডিয়াম টিন অক্সাইড (ITO), এক ধরনের বহুল ব্যবহৃত স্বচ্ছ সেমিকন্ডাকটর, এবং অপরটি হচ্ছে টাংস্টেন ডাই-সালফাইড (WS₂), একটা ফটোএক্টিভ পদার্থ।
Tohoku বিশ্ববিদ্যালয়ের Toshiaki Kato এর নেতৃত্বে পরিচালিত বিজ্ঞানিদের দল ইনডিয়াম টিন অক্সাইড এর ওপরে তামা এবং টাংস্টেন অক্সাইডের পাতলা প্রলেপ দিয়ে এই দুই টাইপের পদার্থকে একে অপরের সংস্পর্শে নিয়ে আসেন।


এই স্পেশাল গঠন এদের আলোকশক্তি সংগ্রহের পরিমান আর সেটাকে বিদ্যুৎশক্তিতে পরিণত করার দক্ষতা বাড়িয়ে দেয়। Kato বলেন,


সাধারণ ITO ইলেক্ট্রোড ব্যবহার করা ডিভাইসের তুলনায় আমাদের ডিভাইসটি সৌরশক্তি রুপান্তরে ১০০০ গুণ বেশি দক্ষ। এভাবে তৈরি করা ডিভাইসটি প্রায় ৭৯% স্বচ্ছতা (AVT) অর্জন করেছে। এখানে শক্তির ঘনত্ব ছিল প্রতি সেন্টিমিটারে ১৩ মিলিওয়াট।



কিন্তু বড় পরিসরে এই টেকনোলজি প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখা দেয় আরেক সমস্যা। দেখা গেল, সোলার সেলের সাইজ বাড়ার সাথে সাথে ওপেন-সার্কিট ভোল্টেজের পরিমান কমে যায়। বিজ্ঞানীরা অবশ্য পরবর্তীতে সোলার সেলের আকার আর অনুপাতের পরিবর্তন করে এই সমস্যারও সমাধান করে ফেলেছেন।

শেষমেষ বিজ্ঞানীরা এক বর্গ সেন্টিমিটার সাইজের সোলার সেল থেকে ৪২০ পিকো ওয়াট পর্যন্ত সৌরশক্তি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন।

এই আবিষ্কারের ভবিষ্যৎ ফলাফল বেশ সুদুরপ্রসারি। এই ধরনের সোলার প্যানেল, সাধারণ জানালাকে সৌরশক্তি উৎপাদনের এক অন্যতম হাতিয়ার বানিয়ে ফেলতে সক্ষম, তাও প্রাকৃতিক আলোকে আটকে না ফেলেই।


 

ফলাফল?


আগাগোড়া গ্লাসে মোড়ানো আকাশছোঁয়া দালান কোঠাগুলো পরিনত হতে পারে একেকটা পাওয়ার প্ল্যান্টে। ইলেকট্রিক গাড়ির বেলায় এসব ট্রান্সপারেন্ট সোলার সেল ব্যবহার করা যেতে পারে তাদের উইনশীল্ড অথবা বডি প্যানেল এ। এতে করে বেড়ে যাবে তাদের রেঞ্জ, আর কমে আসবে চার্জিং স্টেশনের প্রতি তাদের নির্ভরশীলতা। এছাড়াও পরিবর্তন আসবে ওয়্যারেবল (Wearable) টেকনোলজিতেও। স্মার্ট ফোন থেকে শুরু করে ফিটনেস ট্র্যাকার কিংবা কাপড়ের মধ্যে থাকা মেডিক্যাল ডিভাইস, সবকিছুতেই ব্যবহার করা যাবে এই সোলার সেল/প্যানেল। হয়তো সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন এই টেকনোলজি মিশে যাবে মানুষের চামড়ার সাথে, আর শক্তি যোগাবে পেসমেকার কিংবা গ্লুকোজ মনিটরের মতো বায়ো-মেডিকেল ইমপ্ল্যান্ট গুলোকে।



এছাড়াও স্মার্ট ডিভাইসের জগতে আসতে পারে আরেক আলোড়ন। এই বিশেষ স্বচ্ছ সোনাল প্যানেল জায়গা করে নিতে পারে আপনার আমার স্মার্টফোন কিংবা ট্যাবলেটের যন্ত্রাংশে। ফলে বাজারে আসতে চলেছে সেল্ফ-চার্জিং ডিভাইস, যাদের বড় ব্যাটারি কিংবা এক্সট্রা চার্জারের কোন দরকারই হবে না।


এই উদ্ভাবনের আরো আছে সুদূরপ্রসারী পরিবেশগত প্রভাবও।


নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মধ্যে এই সোলার সেল সংযুক্ত করার মাধ্যমে ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানীর ওপর নির্ভরশীলতা ব্যাপকহারে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন গবেষকেরা। ফলে কমে আসবে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে আমাদের বৈশ্বিক জলবায়ুতে।



কিন্তু এই টেকনোলজি বাজারজাত করার পথে বেশ কিছু বাঁধা এখনো রয়ে গেছে। যেমন, এই ডিভাইসগুলো কতটা টেকসই হবে সেটা নিয়ে রয়ে গেছে খানিকটা অনিশ্চয়তা।

কারন জামা কাপড় সহ নানা ধরনের সারফেসে ব্যবহার হওয়া শুরু হলে সেগুলো কতটা ধকল সইতে পারবে সে ব্যপারে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন।

এই প্রযুক্তির বাণিজ্যিক উৎপাদন আরো একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কেননা এই স্বচ্ছ সোলার সেল তৈরি এবং এর পারফরম্যান্স কোয়ালিটি ঠিক রাখতে খুবই নির্দিষ্ট কিছু টেকনিক দরকার হয়, যেটা কারখানার পরিবেশে মেইনটেইন করা বেশ কষ্টসাধ্য।

এছাড়া কাচামালের দামও একটা বড় বিষয়। সাধারণ সিলিকনের চেয়ে TMD কিংবা NISC এর দাম বেশ চড়া। তবে গবেষকেরা সস্তায় এই টেকনোলজি বাজারজাত এবং সবার কাছে সহজলভ্য করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগ যেমন ন্যানোটেকনোলজি, পদার্থ বিজ্ঞান, আর ইঞ্জিনিয়ারিং এর মধ্যেকার সহযোগীতা আর একসাথে কাজ করার মাধ্যমে।




বিজ্ঞানের এই বিভাগগুলো ভবিষ্যতে যতটা উন্নতি করবে, সৌরশক্তি সংগ্রহ আর তার ব্যবহার নিয়ে আমাদের চিন্তা চেতনার সীমানাকে তারা ততই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। 


Kato আরো বলেন, “

এই স্বচ্ছ সৌর কোষের সম্ভাবনা বর্তমানে আমরা যা ভাবছি তার চেয়েও অনেক ব্যাপক।

শহরের অবকাঠামোকে শক্তিশালী করা থেকে শুরু করে কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্সের সাথে মিশে যাওয়া, এই সোলার সেলগুলো এমন একটা টেকসই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায় যেখানে টেকনোলজি আর পরিবেশ হাতে হাত রেখেই চলবে।”

এই গবেষণার ফলাফল ইতিমধ্যে সায়েন্টিফিক রিপোর্টে পাবলিশ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, উদ্ভাবনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে নবায়নযোগ্য শক্তির ইতিহাসে তা একটি মাইলফলক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, যেখানে এই পুরোপুরি স্বচ্ছ সৌর কোষগুলো আমাদের একটা সবুজ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাবে।


তথ্যসুত্রঃ The Brighter Side of News



Comments

Popular posts from this blog

দুধ না খেলে, আসলেই কি হবে না ভালো ছেলে?

দুধ কি আসলেই আমাদের আদর্শ খাদ্য, নাকি স্রেফ  সাদা বিষ ? গত কয়েক দশকে দুধ একটা বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ বলে, দুধ একটা দরকারী পুষ্টিকর খাবার যা কিনা স্বাস্থ্যকর হাড়ের গঠনের জন্য অপরিহার্য। আবার আরেক দল বলে,  দুধ থেকে ক্যান্সার হতে পারে এবং এটা সম্ভবত আমাদের অকালমৃত্যুর একটা কারণ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন দলের দাবী সঠিক? আর, আমরা দুধ কেনইবা পান করি? আসুন জেনে নেয়া যাক... দুধ হচ্ছে সব ধরনের স্তন্যপায়ী প্রানীর ন্যাচারাল ডায়েটের (খাবার) অংশ। জন্মের পর আমাদের প্রথম পুষ্টি আমরা দুধ থেকেই পেয়ে থাকি।  এই সময়ে আমাদের পরিপাক তন্ত্র ছোট আর দুর্বল থাকে। জটিল খাবার খেয়ে হজম করার মত অবস্থা আমাদের থাকে না। তখন মায়ের দুধ স্তন্যপায়ী প্রানীর শরীরের যাবতীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে থাকে। বেসিক্যালি, দুধ হচ্ছে একটা “পাওয়ার ফুড” যা কিনা আমাদের শরীরকে সচল হবার জন্য দরকারী শক্তি দেবার পাশাপাশি আমাদের দ্রুত বেড়ে উঠতেও সাহায্য করে। দুধের মধ্যে প্রচুর পরিমানে স্যাচুরেটেড ফ্যাট (Saturated Fat) , ভিটামিন, মিনারেল আর মিল্ক-স্যুগার রয়েছে, যার নাম ল্যাক্টোজ। এছাড়াও জন্মের পর কিছু সময়ের ...

মানুষের ইচ্ছেতেই হবে এবার কৃত্রিম সূর্যগ্রহণঃ ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির নতুন মিশন

সম্প্রতি ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ESA) একজোড়া নভোযান রওনা দিয়েছে পৃথিবীর কক্ষপথের দিকে।  এদের মূল উদ্দ্যেশ্য সূর্যের করোনামণ্ডল (Corona) নিয়ে গবেষণা করা হলেও এদের ব্যবহার করা যাবে বিজ্ঞানীদের ইচ্ছেমত “সূর্যগ্রহণ” ঘটানোর কাজে।  এমনটাই জানিয়েছেন এই মিশনের গবেষক আন্দ্রেই জুকভ (Andrei Zhukov)। বর্তমানে আন্দ্রেই বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থিত রয়েল অবজারভেটরিতে সোলার ফিজিসিস্ট (Solar Physist) হিসেবে কর্মরত আছেন।  এই মিশনের নাম দেয়া হয়েছে Proba-3। বিজ্ঞানীদের নির্দেশে এই জোড়া নভোযানের একটি আরেকটির ওপর এমনভাবে অবস্থান করবে , যাতে করে সূর্য থেকে আসা আলো পুরোপুরি ঢেকে যায়। আর এভাবেই ঘটানো সম্ভব হবে মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কৃত্রিম পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ।  তবে আপনি আমি পৃথিবীতে বসে এই সূর্যগ্রহণ দেখতে পাবো না এই কৃত্রিম সূর্যগ্রহণের ফলে বিজ্ঞানীরা তীব্র আলোর বাঁধা ছাড়াই সূর্যের করোনামণ্ডলের মাঝের অংশ নিয়ে গবেষণা করতে পারবেন। তারা আশা করছেন এর ফলে গবেষকেরা সূর্যের নানা অজানা আর চমকপ্রদ রহস্যের সমাধান করতে চলেছেন। এসব রহস্যের মধ্যে রয়েছেঃ  সোলার উইন্ড (Solar Wind) বা সৌর ...