Skip to main content

অতিরিক্ত জনসংখ্যাঃ জনবিস্ফোরণের কারণ, ফলাফল, এবং ভবিষ্যৎ

আমাদের মানুষদের সংখ্যা দিন দিন যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে। ইতিহাসের কখনোই আমাদের পৃথিবীতে এখনকার মত এত মানুষ ছিলো না। 

১৮০০ সালে আমরা ছিলাম মাত্র ১ বিলিয়ন, ১৯৪০ সালে হয়ে দাঁড়ালাম ২.৪ বিলিয়ন, ১৯৭০ নাগাদ হলাম ৩.৭ বিলিয়ন আর ২০১৮ নাগাদ আমাদের সংখ্যা হল প্রায় ৮ বিলিয়ন। 

২০২৪ সালের শেষে এসে আমাদের পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮.২ বিলিয়নে। 

অর্থাৎ, গত একশ বছরে আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে চারগুনেরও বেশি। 



তাহলে সামনের ১০০ বছর পরে কি হবে? 

আর জনসংখ্যার এই বিস্ফোরণের প্রভাব আমাদের ভবিষ্যতের ওপর কেমন হবে?

আগামীতে কি

  • উদ্বাস্তুর সংখ্যা কি অতিরিক্ত বেড়ে যাবে?
  • মানুষকে বাধ্য হয়ে অন্য কোন অঞ্চলে পাড়ি দিতে হবে?
  • শহরের বস্তিগুলোতে উপচে পড়া মানুষ থাকবে?
  • শহরগুলো কি মহাদেশের মতই বড় হয়ে যাবে?
  • রোগ-জীবানু ,দূষণ,শক্তি/পানি/খাবারের জন্য সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলার মত সমস্যাগুলো ভয়াবহ আকার ধারন করবে?
  • মানুষ কি শুধু নিজেদের বাঁচাতেই ব্যস্ত থাকবে?
  • জনবিস্ফোরণ কি আমাদের জীবনযাত্রা ধ্বংস করে দিবে?
নাকি এই সব ভবিষ্যৎবানী ভিত্তিহীন আশঙ্কা ছাড়া আর কিছুই না?

চলুন দেখে নেই

১৯৬০ সালের দিকে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আচমকা বেশ খানিকটা বেড়ে যায়, যার ফলে মানুষের মনে নানান ধরনের আশঙ্কা ভর করে। 

গরিবেরা জন্মনিয়ন্ত্রণ না করে বেশি বেশী বংশবিস্তার করে উন্নত বিশ্বকে কোণঠাসা করে ফেলবে

এমন একটা ধারণার জন্ম হয়। আর এইভাবেই তৈরি হয় জনসংখ্যা বিস্ফোরণের মিথ (Myth) বা কল্পগল্প।


কিন্তু পরে দেখা গেল বেশী বেশি বংশবিস্তার কোন নির্দিষ্ট জাতির বৈশিষ্ট্য না, বরং এগুলো হচ্ছে একটা ৪-স্টেপ প্রসেসের ধাপ, যেই প্রসেস পুরো পৃথিবীকেই পার হতে হচ্ছে। 

এই প্রসেসটার নাম “ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন (Demographic Transition)”

অধিকাংশ উন্নত দেশ আগেই এই ট্রানজিশন পার করে ফেলেছে আর বাকী সব দেশ এখনো করছে। কাগজে কলমে এই প্রসেস দেখতে খানিকটা এমনঃ 


চলুন ঘুরে আসি ১৮শ শতকের লন্ডন থেকে, যখন পুরো বিশ্ব (বিশেষ করে ইউরোপ) এই “ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন” এর প্রথম ধাপে ছিল। 

এখনকার অধিকাংশ গরিব দেশের চেয়েও করুণ অবস্থা ছিল লন্ডনের সেদিন। ছিলো না ভালো স্যানিটেশন সুবিধা, ছিলো না পর্যাপ্ত খাবার আর ভালো চিকিৎসা।

অনেক মানুষ জন্মাতো, আবার তাদের মধ্যে অনেক মানুষ জলদি মরেও যেত। তাই জনসংখ্যাও তেমন একটা বাড়েনি। 

মেয়েরা ৪-৬ টা বাচ্চা নিলেও মাত্র ২ টা বাচ্চা বড় হওয়া অব্দি বেঁচে থাকতো।


এরপর যুক্তরাজ্যে এলো শিল্পবিপ্লব (Industrial Revolution), পাল্টে দিল সেখানকার মানুষের জীবন যাত্রার মান। কৃষিবিপ্লবের পর সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। 

মানুষ চাষী থেকে শ্রমিক হয়ে উঠল।

শিল্পকারখানা গুলোতে নিত্যপণ্যের ব্যাপক উৎপাদন শুরু হল, আর সবার মাঝে তা ছড়িয়েও গেল। বিজ্ঞানের ঝলকানিতে একে একে উন্নত হল যোগাযোগ, চিকিৎসা, আর পরিবহণ খাত।

সমাজে নারীর অবস্থান পরিবর্তিত হল আর তারা স্বাধীনতার স্বাদ পেল। 

এই অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে তৈরি হল নতুন এক সামাজিক শ্রেণী, যার নাম “মধ্যবিত্ত”

শিল্পবিপ্লবের ফলে মান বাড়ল গরিবদের জীবনের আর চিকিৎসার।


এই অবস্থায় শুরু হয় “ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন” এর ২য় ধাপ। উন্নত খাবার, চিকিৎসাসেবা আর পরিচ্ছন্নতার কারনে মানুষের অকালে মরে যাওয়া কমে গেল।

ফলাফল? 

১৭৫০ সালে ৬ মিলিয়ন মানুষের যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যা ১৮৫০ সাল নাগাদ বেড়ে হয়ে গেল ১৫ মিলিয়ন

আগের দিনে মানুষ বেশি বাচ্চা নিত কারন তাদের মধ্যে অনেকেই বাচ্চা অবস্থায় মারা যেত। কিন্তু বিপ্লবের পর সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটল আর “ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন” এর ৩য় ধাপের কাজ শুরু হল।

মানুষ কম কম বাচ্চা নেয়া শুরু করে দিল, যার ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আস্তে আস্তে কমে গেল। একটা সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে ভারসাম্য চলে এল। 

তখন মানুষ কম মারা যেত, আবার বাচ্চাও কম নেয়া হত। তাই আস্তে আস্তে জন্মহার আর মৃত্যু হারের মধ্যে একটা ব্যালেন্স চলে আসল।


ব্রিটেন অনেক আগেই এই “ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন” এর ৪র্থ স্তরে পৌঁছে গেছে। 

তবে এই ট্রানজিশন বা পরিবর্তন যে শুধু যুক্তরাজ্যে হয়েছে এমনটা নয়। আস্তে আস্তে সব দেশই এই চার টা ধাপ পার হবে, এখনো হচ্ছে।

তো, এই ধাপগুলো কি কি? সহজ কথায় বলতে গেলে, ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন এর ধাপগুলো খানিকটা এমনঃ 
  • ১ম ধাপঃ জীবন যাত্রার অনুন্নত মানের কারনে অধিক জন্মহার, অধিক মৃত্যুহার।
  • ২য় ধাপঃ জীবন যাত্রার মানের উন্নতির কারনে অধিক জন্মহার, কম মৃত্যুহার। ফলাফল, জনসংখ্যার“বিস্ফোরণ”।
  • ৩য় ধাপঃ কম মৃত্যুহারের কারনে আস্তে আস্তে জন্মহার কমে আসা। কম জন্মহার আর কম মৃত্যুহারের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি।
  • ৪র্থ ধাপঃ উন্নত জীবন যাপন। জনসংখ্যা বিস্ফোরণের সমাপ্তি।

 

এখন কথা হচ্ছে যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেই যায়, তবে পৃথিবীর জনসংখ্যা কমছে না কেন?

এর কারন হচ্ছে, ১৮শ শতকের জনবিস্ফোরণের ফলে জন্ম নেয়া মানুষের ছেলেমেয়েরা/ নাতিপুতিরা (আমরা) এখন বংশবিস্তার করছে। 

কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন, আমরা কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষের তুলনায় অনেক কম বাচ্চা নিচ্ছি।

পরিবারপ্রতি বাচ্চার সংখ্যা এখন ২.৫; যেটা ৪০ বছর আগে ছিল ৫ এ। সুতরাং আশা করা যাচ্ছে আমাদের জেনারেশনের পর থেকেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে আসবে।


তবে সবাই যদি জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি অনুসরণ করে তাহলেই কেবল এমনটা হওয়া সম্ভব। এটা সব দেশের জন্যই সত্যি।

বাংলাদেশের কথাই ধরুন, ১৯৭১ সালের দিকে মেয়েরা গড়ে ৭ টা করে বাচ্চা নিত, যার ২৫% বাচ্চা ৫ বছর বয়সের আগেই মারা যেত।

২০২৩ সালে শিশু মৃত্যুর হার কমে হয়েছে প্রতি হাজারে ২২ জন। আজকের দিনে এসে মেয়েরা গড়ে বাচ্চা নেয় ২ টা করে। সামনে এই হার আরো কমে যাবে।


সব দেশকেই এই প্রসেসগুলো পার করে যেতে হয়। কেউ এই নিয়মের বাইরে না। উন্নত বিশ্ব স্পেশাল কিছু না, তারা শুধু আমাদের থেকে একটু এগিয়ে আছে, এই যা।

কি, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো?


চলুন তাহলে, প্রমান দেখে আসি। আমাদের টার্গেট লোকেশন হচ্ছে সাহারা মরুভুমির দেশ আফ্রিকা, যাকে আমরা সাব-সাহারান আফ্রিকা নামে চিনি। 

২০১৯ সালের দিকে এই মহাদেশের ৪৬টা দেশে সব মিলিয়ে প্রায় ১ বিলিয়ন লোকের বসবাস ছিলো।

যদিও এই অঞ্চলের উচ্চ জন্মহার খানিকটা কমানো সম্ভব হয়েছে, কিন্তু এখনো সেটা বাদবাকী বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশী। 

গবেষকদের মতে, এই অবস্থা বজায় থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ এই অঞ্চলের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৫ বিলিয়নে। এতো বিপুল সংখ্যাক মানুষ লালন পালন করা যেকোন সমাজের জন্যেই বেশ চ্যালেঞ্জিং। 


তার ওপরে এই অঞ্চল আবার পৃথিবীর দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে প্রায় অর্ধেক (৪৮.৪%) মানুষের গড় ইনকাম দৈনিক ২ ডলারেরও নিচে।

এর মানে কি দাঁড়ায়? অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে আফ্রিকার ভবিষ্যৎ কি হুমকির মুখে?

এই প্রশ্নের উত্তরটা বেশ জটিল। আফ্রিকা নামে এক হলেও এখানে অসংখ্য সংস্কৃতির এক মিলনমেলা বসেছে, যাদের নিজেদের মধ্যে যেমন আছে মিল, তেমনি আছে অনেক অমিলও।

মাত্র কয়েক দশক আগেও এশিয়া মহাদেশের অনেকগুলো দেশই আজকের আফ্রিকার মত অবস্থায় ছিলো। জনসংখ্যার অধিকাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করতো, আর জন্মহারও ছিলো অনেক অনেক বেশী।

আমাদের বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। ১৯৬০ সালের হিসেব অনুযায়ী, গড়ে প্রতিটি মহিলা ৭ জন সন্তানের জন্ম দিতেন, যাদের ২৫% বাচ্চা জন্মের ৫ বছরের মধ্যেই মারা যেত।

যারা বেঁচে যেত তাদের মধ্যেও প্রতি ৫ জনে একজন লেখাপড়া করার সুযোগ পেত। মানুষের গড় আয়ু ছিলো মাত্র ৪৫ বছর, আর মাথাপিছু আয় ছিলো সারা বিশ্বে সবচেয়ে কমের দিকেই।

তো, আমরা করলাম কি? সেই ১৯৬০ সাল থেকেই বাংলাদেশ সরকার শুরু করলো “পরিবার পরিকল্পনা” কর্মসূচী। সরকারের এই কর্মসূচীর মূল ভিত্তি ছিলো ৩ টিঃ

  • ১. সবার জন্য শিক্ষা, বিশেষত নারীশিক্ষা অল্প বয়সে মা হবার ঝুঁকি কমালো। শিক্ষিত নারীরা সচেতন হলেন, এবং তুলনামূলকভাবে দেরীতে সন্তান নিতে  নিলেন। ফলে, জন্মহার কমে গেল।
  • ২. চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে শিশুমৃত্যুর হার গেল কমে। বেশি সংখ্যক সন্তান সুস্থ অবস্থায় বেড়ে ওঠার ফলে মানুষের অধিক সংখ্যক সন্তান নেবার প্রবণতাও কমে গেল।
  • ৩. বিপুল সংখ্যক মাঠকর্মী একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সহজে জন্মবিরতিকরণ সামগ্রী পৌঁছে দিলো। ফলাফল, জন্মহার কমে গেল।


ফলে ১৯৭৫ সালে যে জন্মবিরতিকরণ সামগ্রী ব্যবহারের হার ছিলো মাত্র ৮%, সেটা ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়ালো ৭৬% এ।

মিলিতভাবে এই কর্মসূচীগুলো জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনতে ব্যাপক ভুমিকা রেখেছে। 

আগেই বলেছি, ১৯৬০ সালে বাংলাদেশি মহিলারা গড়ে ৭টা বাচ্চা নিতেন। এই সংখ্যা ১৯৯৫ সাল নাগাদ নেমে দাঁড়ালো ৪ এ, আর ২০১৯ সালে সেটা আরো নেমে আসলো মাত্র ২ এ।

এর ফলাফল পড়ল আমাদের দেশের অর্থনীতি আর ডেমোগ্রাফির ওপরেও। আগে অনেক বাচ্চা জন্ম নিতো, কিন্তু বড় হয়ে সমাজ/দেশের পরিবর্তনে অংশ নেয়ার আগেই মারা যেত। 

জন্মহার বেড়ে মৃত্যুহার কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আস্তে আস্তে বদলে গেল।


বাচ্চারা বড় হবার সুযোগ পেল, আর অংশ নিলো সমাজের উন্নয়নে। সরকার শিশু মৃত্যুহার কমানোর ওপর থেকে ফোকাস বদলে অর্থনীতির চাকাকে আরো গতিশীল করে তুলতে সক্ষম হল। 

২০২৪ সাল নাগাদ “অনুন্নত” দেশের তালিকা থেকে “উন্নয়নশীল” দেশের তালিকায় নাম লেখানোর কথা থাকলেও আমরা সেই টার্গেট আগেভাগেই পূরণ করে বসে আছি।

এশিয়ার অন্যান্য দেশ, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড কিংবা ফিলিপাইনও ঠিক একই রকম পরিস্থিতির মোকাবেলা করেই আজকের এই অবস্থানে এসেছে। 


কেউ খুব দ্রুত আবার কেউ ধীরগতিতে ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশনের ধাপগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, 

তাহলে এই একই রকম উন্নয়ন আমরা আফ্রিকায় কেন দেখতে পাচ্ছি না?

গোটা আফ্রিকাতেই শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। তবে সাব-সাহারান অঞ্চলগুলোতে শিক্ষার উন্নয়নের হার পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশ কম।

তাছাড়া জন্মবিরতিকরণ সামগ্রীর ব্যবহার ১৯৯০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে গেলেও এখনো ৬০ শতাংশ কিশোর/তরুনদের কাছে আধুনিক জন্মবিরতিকরণ সামগ্রী পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয় নি।


এর কারন খুবই জটিল, আর এই প্রশ্নের কোন একক উত্তর দেয়াটাও সম্ভব নয়। আফ্রিকা মহাদেশের অনেকগুলো দেশে নানান সংস্কৃতির মানুষের বসবাস। 

তবে প্রধান কারণগুলোর মধ্যে কিছু কারন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

অনেকগুলো সাব-সাহারান দেশ কিছু দশক আগেও অন্যান্য দেশের কলোনী হিসেবেই পরিচিত ছিলো, তাদের নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ যেমন ছিলো প্রকট, আবার তাদের সবাইকেই স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে অনেক কাঠখড়ও পোহাতে হয়েছে।

এসব দেশের মানুষের মধ্যে একতার অভাব থাকার পাশাপাশি তাদের পার করতে হয়েছে সামরিক দ্বন্দ্ব, গৃহযুদ্ধ, কিংবা অস্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থা। 

ফলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর স্বাস্থ্য খাতে মনোযোগ দেয়া খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।




তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শুরুর দিকে আফ্রিকার অবস্থা এশিয়ার চেয়েও খারাপ ছিলো। 

যদিও বিদেশ থেকে আসা সাহায্যের পরিমান আর স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার সেই সাহায্যের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এখনো সম্ভব হয় নি, তবে এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, আর এই বিয়য়টাকে অল্প কথায় পুরোপুরি বোঝানো সম্ভব নয়।

এছাড়াও সাংস্কৃতিক প্রভাব আফ্রিকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে পরিবার পরিকল্পনার ভুমিকা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলাটা চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে।


এক দল মানুষ মনে করেন, উচ্চ জন্মহার কমানোর চেষ্টা করা তাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের পরিপন্থী। 

কিন্তু কথা হচ্ছে, 

কোন সমস্যার বিষয়ে কথা না বলাটা সেটা সমাধানের পথ আরো জটিল করে তোলে।

তবে এই অবস্থা কিন্ত আফ্রিকার সব দেশে দেখা যায় না। আমরা কথা বলছি সাব-সাহারান আফ্রিকার ৪৬ টা দেশ নিয়ে। 

এদের মধ্যে কেউ কেউ গভীর সমস্যায় ডুবে আছে, আবার কেউবা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। সবার সমস্যাই আলাদা।


জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার যদি সামনের দিনগুলোতেও বজায় থাকে, তবে ২১০০ সাল নাগাদ সাব-সাহারান অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা হবে ৪ বিলিয়নেরও বেশি।

তাহলে উপায়? আমাদের হাতে কি কিছুই করার নেই?

আছে, আছে।

অনেক কিছুই করার আছে আমাদের।

তবে আমাদের প্রথম কাজ হবে শিক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা, আর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন করে এমন উদ্যোগকে সাপোর্ট কিংবা সরাসরি ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে সাহায্য করা। 

আপাতদৃষ্টিতে নগণ্য মনে হলেও এসব কর্মকাণ্ডের ফলাফল হয় সুদূরপ্রসারী।

যেমন ধরেন, যদি নারীরা উন্নত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন, আর নিজেদের প্রথম বাচ্চা মাত্র ২ বছর দেরী করে নেন, এই ছোট্ট গ্যাপ তাদের এবং তাদের পরবর্তী জেনারেশনগুলোর মধ্যে ২১০০ সাল নাগাদ ৪০০ মিলিয়ন মানুষ কম জন্মাতে সাহায্য করবে।

আবার, যদি আফ্রিকার প্রতিটা নারীর কাছে পর্যাপ্ত শিক্ষা আর জন্মবিরতিকরণ সামগ্রী পৌঁছে দেয়া যায়, তবে বাচ্চা জন্ম দেয়াটা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে পরিণত হবে।


যদি পরিবারের হাতে বাচ্চার সংখ্যা নিয়ন্ত্রনের ভার তুলে দেয়া যায়, শিশু জন্মহার ৩০% কমে যাবে, যা কিনা আটকে দেবে আরো ২.৮ বিলিয়ন জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে।

এটা কিন্তু শুধুমাত্র থিওরী নয়। অনেকগুলো উদাহরণেই আমরা এমনটা ঘটতে দেখেছে, যা আমাদের আশাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। 

ইথিওপিয়ার কথাই ধরা যাক। আফ্রিকার ২য় বৃহত্তম জনসংখ্যার এই দেশ তুলনামূলক কম সময়ে অবিশ্বাস্য অগ্রগতি দেখিয়েছে।

ইথিওপিয়া ফোকাস করেছিলো তাদের হেলথ কেয়ার প্রোগ্রামে, যা তাদের সাহায্য করেছে শিশুমৃত্যুর হার, যেটা ১৯৯০ সালে ছিলো ২০%, সেটাকে কমিয়ে মাত্র ৭% এ নিয়ে আসতে। 

তারা তাদের বার্ষিক বাজেটের ৩০% পর্যন্ত বরাদ্দ করেছিলো শিক্ষা খাতে। আর এখন মাত্র ২ দশকের মধ্যেই তাদের স্কুলের সংখ্যা বেড়েছে ২৫ গুণ (৩৪০০++)।


যদি সবকিছু ঠিক থাকে, তাহলে গত ৩০ বছরে আমরা এশিয়ায় যে রকম অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের জোয়ার দেখেছি, সাব-সাহারান এই অঞ্চলেও তেমনটাই চোখে পড়বে।

উন্নত বিশ্বের প্রায় ৮০ বছর সময় লেগে গেছে জন্মহার ৬ থেকে ৩ এর নিচে নিয়ে আসতে, মালয়েশিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকা এই একই কাজ করতে সময় নিয়েছে মাত্র ৩৪ বছর। 

এই একই কাজে বাংলাদেশের সময় লেগেছে ২০ বছর আর ইরান মাত্র ১০ বছরেই কাজটা সম্পন্ন করেছে।

এই দেশগুলোকে যত সাহায্য করা হবে তারা তত দ্রুত এই ধাপগুলো অতিক্রম পরতে পারবে। এই জন্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষা, চিকিৎসা আর খাদ্যের উন্নয়ন এত বেশি জরূরী।


আপনি নিজে উন্নত বিশ্বে পরিণত হবার স্বপ্ন দেখেন, না নিজ দেশে উদ্বাস্তু কম আসুক সেটা চান সেটা বড় বিষয় না। 

পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষ ভালো থাকলে আপনার লাভও কিছু কম না। সবাই মিলেমিশেই ভালো থাকার চেষ্টা করা উচিত।

আর আমরা সেদিকে এগোচ্ছিও, কারন দরিদ্রের সংখ্যা দিন দিন কমছে। যদিও ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী এই কমার হার খুবই কম। 

সুতরাং জনসংখ্যা বিস্ফোরণ আমাদের খুব একটা ক্ষতির কারন হবে বলে মনে হয় না। 

আশা করা হচ্ছে, ২১০০ সালের মধ্যেই জনবিস্ফোরণ কমে স্থিতিশীল ভারসাম্য চলে আসতে পারে। 


জাতিসংঘ তো ঘোষণা দিয়েই বসে আছে, 

এ পৃথিবীর জনসংখ্যা কখনই ১২ মিলিয়নের বেশী হবে না।

আর ২১০০ সালের মধ্যেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত লোকের সংখ্যা আজকের ১০ গুন হয়ে যাবে। যেই দেশগুলা আজকে অভাবী আর অনুন্নত, তারাই পথ দেখাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

হ্যা। এটা মেনে নিচ্ছি যে আমাদের সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ, এবং তাদের সমাধান করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।

এসব স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের প্রতি করুণা না করে তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেই আমাদের অতিরিক্ত জনগণ পরিণত হতে পারে জনসম্পদে।



বেশী মানুষ মানে আমাদের প্রজাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার বেশি বেশী হাতিয়ার। 

চাইলে Our World in Data থেকে আপনিও যে কোন দেশের উন্নতির তুলনামূলক তথ্য দেখে নিতে পারেন।

Comments

Popular posts from this blog

চলে এসেছে স্বচ্ছ সৌর কোষঃ সাধারণ সোলার সেলের চেয়ে ১০০০ গুন বেশি কর্মক্ষম

বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন প্রায় স্বচ্ছ এক বিশেষ ধরনের সৌর কোষ বা সোলার সেল। নতুন উদ্ভাবিত এই স্বচ্ছ সোলার সেল সূর্যের আলো থেকে শক্তি উৎপাদন করতে সাধারণ সোলার সেলের চেয়ে ১০০০ গুন বেশি দক্ষ।  গবেষকরা মনে করছেন, এই স্বচ্ছ সোলার সেল নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের ধারণাটাকেই বদলে দেবে, কারন এই সোলার সেল ব্যবহার করা যাবে জানালায়, গাড়িতে, এমনকি সব ধরনের যন্ত্রপাতিতেও।   চলুন জেনে আসি বিস্তারিত... নবায়নযোগ্য শক্তির তালিকায় সৌরশক্তির নামটা প্রথম দিকেই থাকবে, অথচ সাধারণ সোলার সেল তার আকার, দৃঢ়তা, আর অস্বচ্ছতার কারণে খুব বেশিদুর এগোতে পারে নি। এই সব বাধা বিপত্তির কারণে সৌরশক্তি এতোদিন ধরে আটকে ছিলো শুধুমাত্র বাড়ির ছাদে, কিংবা খোলা মাঠে। এই সব বাধা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করতে বহুদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছিলেন অসংখ্য বিজ্ঞানী আর গবেষক। তারা চেষ্টা করছিলেন যাতে সহজে, কম খরচে একটা স্বচ্ছ সোলার সেল (Transparent Solar Cell) বা TSC তৈরি করা যায়। এটি করতে পারলে তারা অন্যান্য সব সারফেস থেকেও সৌরশক্তি সংগ্রহ করতে পারবেন। সম্প্রতি গবেষকেরা বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন এমন ধরনের TSC তৈরি করা সম্ভব হয়েছে যা ...

দুধ না খেলে, আসলেই কি হবে না ভালো ছেলে?

দুধ কি আসলেই আমাদের আদর্শ খাদ্য, নাকি স্রেফ  সাদা বিষ ? গত কয়েক দশকে দুধ একটা বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ বলে, দুধ একটা দরকারী পুষ্টিকর খাবার যা কিনা স্বাস্থ্যকর হাড়ের গঠনের জন্য অপরিহার্য। আবার আরেক দল বলে,  দুধ থেকে ক্যান্সার হতে পারে এবং এটা সম্ভবত আমাদের অকালমৃত্যুর একটা কারণ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন দলের দাবী সঠিক? আর, আমরা দুধ কেনইবা পান করি? আসুন জেনে নেয়া যাক... দুধ হচ্ছে সব ধরনের স্তন্যপায়ী প্রানীর ন্যাচারাল ডায়েটের (খাবার) অংশ। জন্মের পর আমাদের প্রথম পুষ্টি আমরা দুধ থেকেই পেয়ে থাকি।  এই সময়ে আমাদের পরিপাক তন্ত্র ছোট আর দুর্বল থাকে। জটিল খাবার খেয়ে হজম করার মত অবস্থা আমাদের থাকে না। তখন মায়ের দুধ স্তন্যপায়ী প্রানীর শরীরের যাবতীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে থাকে। বেসিক্যালি, দুধ হচ্ছে একটা “পাওয়ার ফুড” যা কিনা আমাদের শরীরকে সচল হবার জন্য দরকারী শক্তি দেবার পাশাপাশি আমাদের দ্রুত বেড়ে উঠতেও সাহায্য করে। দুধের মধ্যে প্রচুর পরিমানে স্যাচুরেটেড ফ্যাট (Saturated Fat) , ভিটামিন, মিনারেল আর মিল্ক-স্যুগার রয়েছে, যার নাম ল্যাক্টোজ। এছাড়াও জন্মের পর কিছু সময়ের ...

মানুষের ইচ্ছেতেই হবে এবার কৃত্রিম সূর্যগ্রহণঃ ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির নতুন মিশন

সম্প্রতি ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ESA) একজোড়া নভোযান রওনা দিয়েছে পৃথিবীর কক্ষপথের দিকে।  এদের মূল উদ্দ্যেশ্য সূর্যের করোনামণ্ডল (Corona) নিয়ে গবেষণা করা হলেও এদের ব্যবহার করা যাবে বিজ্ঞানীদের ইচ্ছেমত “সূর্যগ্রহণ” ঘটানোর কাজে।  এমনটাই জানিয়েছেন এই মিশনের গবেষক আন্দ্রেই জুকভ (Andrei Zhukov)। বর্তমানে আন্দ্রেই বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থিত রয়েল অবজারভেটরিতে সোলার ফিজিসিস্ট (Solar Physist) হিসেবে কর্মরত আছেন।  এই মিশনের নাম দেয়া হয়েছে Proba-3। বিজ্ঞানীদের নির্দেশে এই জোড়া নভোযানের একটি আরেকটির ওপর এমনভাবে অবস্থান করবে , যাতে করে সূর্য থেকে আসা আলো পুরোপুরি ঢেকে যায়। আর এভাবেই ঘটানো সম্ভব হবে মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কৃত্রিম পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ।  তবে আপনি আমি পৃথিবীতে বসে এই সূর্যগ্রহণ দেখতে পাবো না এই কৃত্রিম সূর্যগ্রহণের ফলে বিজ্ঞানীরা তীব্র আলোর বাঁধা ছাড়াই সূর্যের করোনামণ্ডলের মাঝের অংশ নিয়ে গবেষণা করতে পারবেন। তারা আশা করছেন এর ফলে গবেষকেরা সূর্যের নানা অজানা আর চমকপ্রদ রহস্যের সমাধান করতে চলেছেন। এসব রহস্যের মধ্যে রয়েছেঃ  সোলার উইন্ড (Solar Wind) বা সৌর ...