সম্প্রতি ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ESA) একজোড়া নভোযান রওনা দিয়েছে পৃথিবীর কক্ষপথের দিকে।
এদের মূল উদ্দ্যেশ্য সূর্যের করোনামণ্ডল (Corona) নিয়ে গবেষণা করা হলেও এদের ব্যবহার করা যাবে বিজ্ঞানীদের ইচ্ছেমত “সূর্যগ্রহণ” ঘটানোর কাজে।
এমনটাই জানিয়েছেন এই মিশনের গবেষক আন্দ্রেই জুকভ (Andrei Zhukov)। বর্তমানে আন্দ্রেই বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থিত রয়েল অবজারভেটরিতে সোলার ফিজিসিস্ট (Solar Physist) হিসেবে কর্মরত আছেন।
এই মিশনের নাম দেয়া হয়েছে Proba-3। বিজ্ঞানীদের নির্দেশে এই জোড়া নভোযানের একটি আরেকটির ওপর এমনভাবে অবস্থান করবে, যাতে করে সূর্য থেকে আসা আলো পুরোপুরি ঢেকে যায়।
আর এভাবেই ঘটানো সম্ভব হবে মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কৃত্রিম পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ।
তবে আপনি আমি পৃথিবীতে বসে এই সূর্যগ্রহণ দেখতে পাবো না
এই কৃত্রিম সূর্যগ্রহণের ফলে বিজ্ঞানীরা তীব্র আলোর বাঁধা ছাড়াই সূর্যের করোনামণ্ডলের মাঝের অংশ নিয়ে গবেষণা করতে পারবেন।
তারা আশা করছেন এর ফলে গবেষকেরা সূর্যের নানা অজানা আর চমকপ্রদ রহস্যের সমাধান করতে চলেছেন। এসব রহস্যের মধ্যে রয়েছেঃ
- সোলার উইন্ড (Solar Wind) বা সৌর বায়ু কিভাবে উৎপন্ন হয়?
- সোলার উইন্ড এর গতি বাড়ে কিভাবে?
- করোনামণ্ডলের তাপমাত্রা কেন সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার চেয়েও এতো বেশি হয়?
- করোনাল মাস ইজেকশন(CME) কিভাবে বিলিয়ন বিলিয়ন টন প্লাজমা মহাকাশে ছড়িয়ে দেয়?
এখানে বলে রাখা ভালো, করোনামণ্ডল হচ্ছে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের সবথেকে বাইরের স্তর, মিলিয়নের পর মিলিয়ন কিলোমিটার জুড়ে যার অবস্থান। এই করোনা আমরা শুধুমাত্র দেখতে পাই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় কিংবা নাসার সোলার ডায়নামিক অবজারভেট্রির (SDO) মাধ্যমে।
এই অঞ্চলের তাপমাত্রা সূর্যের সারফেসের তাপমাত্রার প্রায় ৩০০ গুন পর্যন্ত হয়ে থাকে। এখানে পাওয়া যায় অতিউত্তপ্ত প্লাজমা, যা আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে পরিণত হয় সোলার ফ্লেয়ার (Solar Flare) বা সোলার উইন্ডে।
নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে একেকটা মাঝারি সাইজের সোলার ফ্লেয়ার আমাদের পৃথিবীর তুলনায় কত বড় হয়ে থাকে। অবশ্য এর চেয়েও বড় সোলার ফ্লেয়ার সূর্যে অহরহই দেখা যায়।
মাটিতে বসে বিজ্ঞানীরা এই দুটি নভোযানের অবস্থান এক মিলিমিটার (মানুষের নখের পুরুত্ব) দূরত্ব পর্যন্ত সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রন করেতে পারবেন।
দেখতে সাধারণ কিউবের মত এই নভোযান আকারে ৫ ফিট বা দেড় মিটারের কাছাকাছি। এদের মধ্যে একটিতে থাকবে একটা অকাল্টার (Occulter) বা ডিস্ক, যা সূর্য থেকে আসা আলোকে পুরোপুরি ঢেকে দেবে, ঠিক যেমনটা প্রাকৃতিক সূর্যগ্রহণের সময় আমাদের চাঁদ করে থাকে।
আর অন্য স্যাটেলাইট কাজ করবে আঁধারে ঢেকে যাওয়া পৃথিবীর মত, যেখান থেকে আমরা সূর্যের বায়ুমণ্ডলের ওপর গবেষণা চালাতে পারবো।
এছাড়াও এই মিশনের আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আগেই বলেছি, এই জোড়া নভোযান একসাথেই তাদের যাত্রা শুরু করেছে। মানে, একে অন্যের সাথে আঠা দিয়ে লেগে থাকার মত খানিকটা।
এই বিশেষ টেকনিককে বলা হয় প্রিসিশন ফরমেশন ফ্লাইং (Precision Formation-flying) । সামরিক মহড়াতে নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন অনেগুলো জেট বিমান একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নে উড়ে চলে। এটাকেই ফরমেশন ফ্লাইং বলে।
সব ঠিক থাকলে এই টেকনিক আমাদের ভবিষ্যতে দারুন কাজে দেবে। যেমন ধরেন, অনেকগুলো টেলিস্কোপ একসাথে জোড়া লাগিয়ে অনেক বড় আর পাওয়ারফুল একটা টেলিস্কোপ তৈরি করা।
আমরা ছোট ছোট অনেকগুলো যন্ত্রাংশ একে একে মহাকাশে পাঠিয়ে সেখানে তাদের জোড়া লাগিয়ে তৈরি করতে পারবো আরো অনেক আধুনিক আর জটিল সব যন্ত্রপাতি।
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির পক্ষ থেকে মিশনের বিজ্ঞানী জো যেন্ডার (Joe Zender) জানান, “এই নভোযান দুটি সময়ভেদে পৃথিবীর ৬০০-৬০,০০০ কি মি দূরে থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করবে।
পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘুরে আসতে এদের সময় লাগবে প্রায় ২০ ঘন্টার মত। বাকী সময় নানা ধরনের ফরমেশন ফ্লায়িং পরীক্ষায় ব্যবহৃত হবে এই স্পেসক্রাফট দুটি।
এই নভোযানদ্বয়ের একটি অন্যটির সামনে গিয়ে সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দিলে অপরটি সূর্যের স্বচ্ছ বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে ভেতরের অংশের হাই-রেজুলেশন ছবি তুলে আমাদের পাঠানো শুরু করবে।
এরা নিজেরদের অবস্থান ঠিক রাখার জন্য লেজার, রেডিও, আর জিপিএস (GPS) টেকনোলজি ব্যাবহার করবে।
সাধারণত সূর্যের তীব্র আলোর জন্য করোনামণ্ডলের ছবি তোলা আমরা তুলতে পারি না। তাই বর্তমানে স্যাটেলাইট থেকে আলোর আল্ট্রা ভায়োলেট (Ultra-violate) বা অতিবেগুনি তরঙ্গদৈর্ঘ্য ব্যবহার করে আমাদের এসব ছবি তুলতে হয়।
যদিও টেলিস্কোপের সামনে করোনাগ্রাফ (Coronagraph) নামের এক বিশেষ ধরনের ডিস্ক বসিয়ে আমরা পৃথিবীতে বসেই কৃত্রিম সূর্যগ্রহণ ঘটাতে পারি, কিন্তু আলোর অপবর্তনের (Diffraction) কারণে সূর্য থেকে আসা আলো সেই ডিস্কের কিনারা ঘেষে বেঁকে যায়, আর আমাদের তোলা ছবি নষ্ট করে দেয়।
ফলে সূর্যের করোনামন্ডল এখনো রয়েছে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এছড়াও সূর্যের নানা রহস্য আজো আমাদের অজানা। যেমন ধরেন, কোন গরম বস্তু থেকে যত দূরে আমরা যায়, আমাদের চারপাশের তাপমাত্রা তত কমতে থাকে। তাই না?
সূর্যের করোনার বেলায় ব্যাপারটা ঠিক উলটো। সূর্যের সারফেস থেকে যত দূরে আপনি যেতে থাকবেন, আশে পাশের তাপমাত্রা ততই বাড়তে থাকবে।
খাতা কলমে এই হিসেব গিয়ে দাঁড়ায় সাড়ে তিন মিলিয়ন ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ২ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যেখানে সূর্যের সারফেস বা ফটোস্ফিয়ারের (Photosphere) তাপমাত্রা এর তুলনায় অনেক কম (১০ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৫.৫ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস মাত্র)।
এই বিষয়টা বিজ্ঞানীদের এতোদিন ধরে অনেক ভাবিয়েছে। সূর্যের সারফেসের ঠিক ওপরের অংশ নিয়ে গবেষণা করতে চাইলে বিজ্ঞানীদের বসে থাকতে হয় পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের আশায়।
কিন্তু পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয় কয়েক বছর পর পর, আর সেটাও দেখা যায় কেবলমাত্র পৃথিবীর কিছু অংশ থেকে, মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যে।
অন্যদিকে Proba-3 বিজ্ঞানীদের নির্দেশে যেকোন সময়ে সূর্যগ্রহণ ঘটাতে পারবে, যা স্থায়ী হবে ৬ ঘন্টা পর্যন্ত। সপ্তাহে দুই বার পর্যন্ত ঘটানো হবে এই কৃত্রিম সূর্যগ্রহণ।
ফলে বিজ্ঞানীরা সূর্যের বায়ুমণ্ডলের ওপর আরো বিস্তারিত গবেষণা করা সুযোগ পাবেন। তারা জানতে পারবেন সূর্যের করোনামন্ডল সময়ের সাথে সাথে কিভাবে বদলায়।
এছাড়াও বিজ্ঞানীর গবেষণা করবেন সৌর ঝড় (Solar Storm) নিয়ে। পৃথিবীর নানা জায়গায় অসাধারণ দেখতে মেরুজ্যোতি (Aurora) সৃষ্টি করার পাশাপাশি এসব সৌর ঝড়ের কারণে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা আর ইলেকট্রিসিটি সরবরাহ ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে।
এই মিশনে সর্বমোট খরচ হচ্ছে ২১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার বর্তমান বাজারমুল্য বাংলাদেশি টাকায় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।
আগামী বছর থেকেই শুরু হচ্ছে এই মিশনের কার্যক্রম। মার্চ নাগাদ প্রথম কৃত্রিম সূর্যগ্রহণ ঘটানো সম্ভব হবে বলে আশা করছেন গবেষকেরা।
Proba-3 নভোযানদ্বয়ের মধ্যের দুরত্ব নিয়ন্ত্রনের সুযোগ থাকায় এখানে অপবর্তনের ঝামেলাও কম থাকবে। কারন আলো আটকানো বস্তু (Occulter) পর্যবেক্ষক (Observer) থেকে যত দূরে থাকবে, অপবর্তনের মাধ্যমে তত বেশি আলো চারদিকে ছড়িয়ে যাবে।
Proba-3 এর কাজ হচ্ছে এই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া আলোর পরিমান কমিয়ে দেয়া। এমনটাই জানালেন যুক্তরাস্ট্রের কলোরাডোতে অবস্থিত সাউথইস্ট রিসার্চ সেন্টারের পদার্থবিদ আমির কাসপি (Amir Caspi)।
তিনি আরো বলেন, “Proba-3 এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ক্ষমতা হচ্ছে, এর মাধ্যমে আমরা অকাল্টারটাকে এতো দূরে বসাতে পারছি, যেটা একটা নভোযান দিয়ে বসানো সম্ভব না।
এর ফলে আমরা আমাদের ইচ্ছে মত অকাল্টারের সাইজ পরিবর্তন করতে পারবো আর সূর্যের সারফেসের আরো কাছাকাছি আমাদের নজর নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।”
কিন্তু সব সময়ে একই পজিশনে অবস্থান করতে অনেক বেশি জ্বালানী দরকার পরবে। তাই এই নভোযান দুটি অধিকাংশ সময় সূর্যের চারদিকে ঘুরে বেড়াবে, আমাদের পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা অন্যান্য স্যাটেলাইটের মতই।
তবে বিজ্ঞানীরা Proba-3 এর দুই বছরের মিশনে ১০০০ এরও বেশি বার কৃত্রিম সূর্যগ্রহণ ঘটাতে পারবেন বলে ধারণা করছেন। মিশন শেষে আগামী বছর পাঁচেকের মধ্যে এদেরকে ধীরে ধীরে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হতে পারে।
কাসপির মতে Proba-3 এবং এর পরের কিছু মিশন থেকে পাওয়া তথ্য আমাদের আগামী দশকের মহাকাশ গবেষণার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। তিনি আরো বলেন,
“ফরমেশন ফ্লাইয়িং পদ্ধতির বেশ অভিনব একটা ব্যবহার আমরা দেখতে যাচ্ছি, যেটা দিয়ে এমন কিছু করা যাবে যা আগে প্রায়, কিংবা পুরোপুরিই অসম্ভব ছিলো। এর ফলে আমরা মহাকাশ গবেষণা আর আবিষ্কারের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছি, যেটাতে আমাদের প্রবেশাধিকার ছিলো না।”
তবে আপনাকে আমাকে নেক্সট প্রাকৃতিক পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখতে চাইলে ১২ আগস্ট ২০২৬ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
তথ্যসুত্রঃ
- A spacecraft duo will fly in formation to create artificial solar eclipses
- European satellites launched to create artificial solar eclipses in a tech demo | News Channel 3-12
Comments
Post a Comment