Skip to main content

অন্তিমযাত্রার পথে নাসার ভয়েজার প্রোবঃ চিরবিদায়ের হাতছানি

১৯৭৭ সালের আগস্ট আর সেপ্টেম্বর মাসে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে মহাশুন্যের পথে তাদের অসীম যাত্রা শুরু করে নাসার ভয়েজার ১ আর ২ নামের দুটি স্পেস প্রোব। 🚀

তারা শুধু পৃথিবী নয়, আমাদের সুবিশাল সৌরজগৎ পেরিয়েও এগিয়ে গেছে আরো অনেক দূর।



ভয়েজার ১ আর ২ এর মিশন শেষ হয়ে যাবে মাত্র ৫ বছরেই, শুরুতে এমনটা ধারণা করা হলেও দূরদর্শী বিজ্ঞানী আর ইঞ্জিনিয়ারদের প্রচেস্টায় আজ ৪৭ বছর পরেও সচল আছে প্রোব দুটি।

কিন্তু সবকিছুরই শেষ আছে। আজ প্রায় অর্ধশতাব্দি পর আমরা জানতে পেরেছি ভয়েজার ১ আর ২ তাদের জীবনকালের প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আর কিছুদিন পরেই হয়তো মানব সভ্যতার এই অমূল্য নিদর্শন চিরতরে হারিয়ে যাবে মহাশূন্যের অতল গহবরে।

কিভাবে? আসুন দেখে নেই।


অসীম মহাশুন্যকে জানার উদ্যেশ্যে মানুষের পাঠানো অসংখ্য প্রোবের মধ্যে কেবলমাত্র ভয়েজারই সৌরজগৎ পেরিয়ে গভীর মহাশুন্য বা ডিপ স্পেসের (Deep Space) দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছে।

শুধু তাই নয়, আজ পর্যন্ত মানুষের পাঠানো সবচেয়ে বেশি দুরত্ব ভ্রমন করা এই প্রোব দুটি প্রায় অর্ধশতাব্দি পরেও এখনো সচল। তাদের এই লম্বা সময় ধরে কার্যকর থাকার পেছনে রয়েছে পারমাণবিক শক্তি।

কিন্তু

নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়

 — কবি জীবনানন্দের এই উক্তির স্বার্থকতা রক্ষা করতেই বোধহয় আস্তে আস্তে নিভে আসছে তাদের জীবনপ্রদীপ।

ভয়েজারের মিশন শুরু হয় গ্রহদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়ার উদ্দ্যেশ্যে। 

এই যমজ প্রোব দুটির কাজ ছিল আমাদের সৌরজগতে থাকা গ্রহগুলোর, বিশেহ করে সৌরজগতের বাইরের দিকের গ্রহ যেমন বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস আর নেপচুনের কাছে গিয়ে তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা।

আজকের দিনে বসে আমরা যে এইসব গ্রহের ব্যাপারে এতো কিছু জানিঃ 

  • তারা দেখতে কেমন
  • তাদের আবহাওয়া কেমন
  • তারা কি কি পদার্থ দিয়ে তৈরি
  • তারা কিভাবে সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে

— এ সব কিছুর পেছনে আছে ভয়েজার প্রোবের মধ্যে থাকা হাই-রেজুলেশন রোবটিক ক্যামেরা আর অন্যান্য বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি।


এদের মধ্যে বরফে ঢাকা আইস জায়ান্ট ইউরেনাস আর নেপচুনের ওপর স্পাইগিরী করার দায়িত্বে ছিল ভয়েজার ২। মানব ইতিহাসে ভয়েজার ২ই প্রথম এবং একমাত্র প্রোব যে ইউরেনাস আর নেপচুনের খুব কাছে গিয়ে তাদের ওপর গবেষনা চালিয়েছে।

এছাড়াও ভয়েজার ২ বৃহস্পতি আর শনি গ্রহের ব্যাপারেও আমাদের নানান অবাক করা তথ্য জানিয়েছে, যার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে সেখানে আমরা পাঠিয়েছি গ্যালিলিও, জুনো, আর ক্যাসিনির মত স্পেস মিশন।

অন্যদিকে, ভয়েজার ১ এর কাজ ছিলো খানিকটা ভিন্ন। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় শনি গ্রহের সবচাইতে বড় উপগ্রহ আর আমাদের সৌরজগতের বাইরের দিকের অন্যতম আকর্ষণ — টাইটানের ওপর নজর রাখার।

ভয়েজার প্রোবদুটির গ্রহের ওপর নজরদারী করার মিশন শেষ হলে তারা নতুন মিশন বুঝে নেবার জন্য তৈরি হয়ে যায়।

এই পথচলার শেষ পর্যায়ে গিয়ে তারা অর্জন করে সৌরজগতের মুক্তিবেগ, যেটা তাদের সাহায্য করে সূর্যের গ্র্যাভিটি থেকে মুক্তি হয়ে ডিপ স্পেসের দিকে এগিয়ে যেতে।

২০১২ সালের পর থেকেই ভয়েজার ১ আর ২০১৮ সালের পর ভয়েজার ২ তাদের ইন্টারস্টেলার যাত্রা শুরু করে।

তো আমরা এটা কিভাবে বুঝলাম?

আমরা খেয়াল করলাম এই সময়ের পরে ভয়েজার ১ আর ২ এর সেন্সরে সূর্য থেকে আসা চার্জড পার্টিকেলের সংখ্যা আর শক্তির পরিমান তুলনামূলকভাবে কমে গেল।

তখনই নাসা বুঝতে পারলো, আমাদের সৌরজগতের শেষ সীমানা আর তার বাইরের পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করার এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। আর তাই আমরা তাদের ঠেলে দিলাম অসীম মহাশুন্যের পথে।

সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভয়েজার ১ অসীমের দিকে ছুটে চলেছে ঘন্টায় ৩৮ হাজার মাইল বা সেকেন্ডে ১৭ কি.মি. বেগে। আর ভয়েজার ২ এর গতিবেগ হচ্ছে ঘন্টায় ৩৪ হাজার মাইল বা সেকেন্ডে ১৫.৬ কি.মি.

ভয়েজার ১ এখন পর্যন্ত অতিক্রম করেছে ২২ বিলিয়ন কি.মি., আর ভয়েজার ২ অতিক্রম করেছে ১৮ বিলিয়ন কি.মি.।

তো এখন প্রশ্ন হচ্ছে,

এতো সময় ধরে চলে আসা মিশন শেষ করে এতোদূর যাবার মত চালিকাশক্তি ভয়েজার পেলো কোথায়?

সোলার প্যানেল দিয়ে খানিকটা সমাধান হয়তো হতে পারে, কিন্তু সূর্য থেকে দূরে চলে গেলে সৌরশক্তির পরিমানও কমতে থাকে। তাই আমাদের চাই আরো টেকসই একটা সমাধান।

এই সমাধানের নাম হচ্ছে রেডিও-আইসোটোপ থার্মো-ইলেকট্রিক জেনারেটর, যাকে সংক্ষেপে ডাকা হয় RTG নামে। RTG হচ্ছে ছোট্ট পাওয়ার জেনারেটর যেটা ভয়েজার ১ আর ২ এ থাকা কম্পিউটারে নিরবিচ্ছিন্ন শক্তি সরবরাহ করতে পারে।

প্রতিটা RTG তে আছে প্লুটোনিয়াম-২৩৮ অক্সাইডের তৈরি ২৪ টা গোলক, যার মোট ওজন ৪.৫ কেজি।

এই সব গোলকের মধ্যে থাকে প্লুটোনিয়াম-২৩৮, একটা অস্থায়ী আইসোটোপ, যেটা ক্রমাগত আলফা পার্টিকেল নিঃসরণ করে। প্রতিটা আলফা পার্টিকেলের মধ্যে থাকে দুইটা করে প্রোটন আর দুইটা নিউট্রন।

এই প্রোটন আর নিউট্রন ক্রমাগত RTG ক্যানিস্টারের গায়ে ধাক্কা দিয়ে তাপশক্তি উৎপন্ন করে, আর সেই তাপকে পরিণত করা হয় বিদ্যুৎশক্তিতে।

সময়ের সাথে সাথে RTG তে উৎপন্ন হওয়া আলফা পার্টিকেলের সংখ্যা কমতে থাকে, আর সেই সাথে কমতে থাকে শক্তি উৎপাদনের পরিমানও। আর এই কারনেই ভয়েজার ১ আর ২ আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে।

সাধারণ পারমাণবিক ব্যাটারির সর্বোচ্চ জীবনকাল হচ্ছে ৬০ বছর, তার মানে ভয়েজার ১ আর ২ এর হাতে সময় আছে মাত্র এক যুগের কিছু বেশি। তাই এই প্রোবদুটির শক্তি খরচ কমানোর জন্য কন্ট্রোল টিম ক্রমাগত চেষ্টা করেই যাচ্ছে।

যেমন ধরেন, গত অক্টোবরে ভয়েজার ২ এর প্লাজমা ডিটেক্টর বন্ধ করে দেয়া হয়। 

ভয়েজার ১ এর প্লাজমা ডিটেক্টর বন্ধ করা হয়েছে ২০০৭ সালে, যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে।

আগেই বলেছি, প্লাজমা ডিটেক্টর এর কাজ হচ্ছে প্রোবের চারপাশে থাকা চার্জড পার্টিকেলের সংখ্যা আর শক্তি পরিমাপ করা। 

এই প্লাজমা ডিটেক্টর এর মাধ্যমেই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে ভয়েজার ২ হেলিওস্ফিয়ার (Heliosphere) থেকে বের হয়ে ইন্টারস্টেলার যাত্রা শুরু করেছে।

ভয়েজার ১ আর ২ এ এখন একটা ম্যাগনেটোমিটার সহ মোট চারটা যন্ত্র চালু আছে মাত্র, যেগুলো দিয়ে ডীপ স্পেসের মহাজাগতিক রশ্মি আর ইন্টারস্টেলার ম্যাগনেটিক ফিল্ড পরিমাপ করা যায়।

কিন্তু এই যন্ত্রগুলোও তাদের জীবনের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে।

যদিও এটা একেবারে ঠিক করে বলা সম্ভব নয়, তবে আগামী বছর দশেকের মধ্যেই ভয়েজার ১ আর ২ এর থাকা পারমাণবিক ব্যাটারীর চার্জ পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে।

আমরা চিরতরে হরিয়ে ফেলবো মানব সভ্যতার এক অমূল্য স্মৃতিচিহ্ন আর মহাবিশ্বের বুকে আমাদের উপস্থিতির প্রমাণ বয়ে নিয়ে চলা মেসেঞ্জারদের।

তথ্যসুত্রঃ WIRED

Comments

Popular posts from this blog

ময়না তদন্ত সিরিজ — পর্ব একঃ ফিজিক্স

এই সুবিশাল আর ভয়ংকর সুন্দর মহাবিশ্বের অগণিত রহস্য বের করার উপায়কে আমরা বিজ্ঞান হিসেবে জানি। সুতরাং এই অসীম মহাবিশ্বের মতই বিজ্ঞানের পরিধিও সুবিশাল।  আর এই বিজ্ঞানের অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে ফিজিক্স (Physics) বা পদার্থবিদ্যা।  আক্ষরিক ভাবে বলতে গেলে ফিজিক্স হচ্ছে নলেজ অফ ন্যাচার (Knowledge of Nature)  বা প্রকৃতি বিষয়ক জ্ঞান অতিক্ষুদ্র সাব-এটমিক পার্টিকেল (Sub-atomic Particle) থেকে শুরু করে নক্ষত্রখেকো ব্ল্যাক হোল , সব কিছু কিভাবে জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে, মহাবিশ্ব চষে বেড়ায়, আর শেষে মারা যায় —  এসব বুঝতে হলে আমাদের ফিজিক্সের শরণাপন্ন হতেই হয়। আমাদের সমাজে ফিজিক্স একটা ভীতির নাম। গাদা গাদা সমীকরণ মুখস্থ করে পাশ তো আমরা করি ঠিকই কিন্তু ফিজিক্সের আসল ম্যাজিক আজীবন আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যায়। সেই অবস্থা পরিবর্তন করতেই  এ ক্ষুদ্র প্রয়াস বলতে পারেন। এখানে আমি সহজ ভাষায় ফিজিক্সের অন্তর্গত বিষয়গুলো নিয়ে খানিকটা আলাপ করবো। তবে চলুন কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক আমাদের এখন পর্যন্ত চেনাজানা ফিজিক্সের জগতকে আমরা মোটামুটি ৩ ভাগে ভাগ করতে পারি  ক্ল্যসিক্যাল ফিজিক্স (Classical P...

১.৬ লাখ বছর পর পৃথিবীর আকাশে ফিরে এল ধূমকেতুঃ C/2024 G3 অ্যাটলাস

অতি সম্প্রতি আমাদের দেখা দিয়ে গেল আমাদের সৌরজগতের মহাকাশের অন্যতম উজ্জ্বল এক সদস্য।  ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০ বছরের মধ্যে যতগুলো ধূমকেতু দেখা যাবে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল হচ্ছে C/2024 G3 অ্যাটলাস নামের এই ধূমকেতু। তবে সবচাইতে অবাক করা বিষয়টি হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে পরিচিত হ্যালির ধূমকেতুর মত এই ধূমকেতু কিন্তু ৭৬ বছর পর পর ফিরে আসে না।  সূর্যের চারদিকে নিজের কক্ষপথে একবার পুরোটা ঘুরে আসতে এই অ্যাটলাস ধূমকেতুর সময় লাগে দেড় লাখ বছরেরও বেশি সময়। হ্যা, আপনি ঠিকই দেখছেন C/2024 G3 অ্যাটলাস ধূমকেতু প্রতি ১ লাখ ৬০ হাজার বছর পর পর একবার করে পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান হয়। চলুন দেখে নেয়া যাক বিস্তারিত। এই C/2024 G3 ধূমকেতু সর্বপ্রথম আমাদের নজরে আসে গত বছরের (২০২৪) এপ্রিলে, আমাদের নাসা নিয়ন্ত্রিত মহাজাগতিক বস্তুর ওপর নজরদারী করা রোবট অ্যাটলাসের ( Asteroid Terrestrial-impact Last Alert System - ATLAS ) মাধ্যমে।  ফলে, ধূমকেতুটার নাম দেয়া হয় C/2024 G3 অ্যাটলাস বিজ্ঞানীরা ধূমকেতুর কক্ষপথ গবেষণা করে বের করেছিলেন যে এই ধূমকেতু জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে সূর্যের খুব কাছ দিয়ে অতিক্রম করবে। এই সময়ে...