বাঘে মহিষে এক ঘাটে পানি খাবার কথা তো আমরা অনেকেই শুনেছি। কিন্তু খালি চোখে রাতের আকাশে ২/৩ টার বেশি গ্রহ একসাথে কবে দেখছেন মনে করতে পারবেন?
সেই সম্ভাবনা আসলে খুব একটা বেশি না। তবে আপনি যদি মহাকাশ সম্পর্কে আগ্রহী হন, তবে আপনার জন্য রয়েছে দারুন এক সুসংবাদ।
আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এমন কিছু খালি চোখে দেখার সুযোগ আসছে।

কিভাবে? আসুন জেনে নেই বিস্তারিত
বর্তমানে, মানে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে আমাদের সৌরজগতের ৬ টি গ্রহ রাতের আকাশে খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। গ্রহগুলো হচ্ছেঃ মঙ্গল (Mars), বৃহস্পতি (Jupiter), ইউরেনাস (Uranus), শনি (Saturn), আর নেপচুন (Neptune)।
গত বছরের ডিসেম্বর থেকেই একে একে পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান হতে শুরু করে এই গ্রহগুলো। দেখে মনে হয় যেন গ্রহগুলো আকাশের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় এক বেঁকে যাওয়া লাইনে সারি বেধে অবস্থান নিতে শুরু করে।
এই ঘটনার নাম “প্ল্যানেটরি প্যারেড (Planetary Parade)”

সাধারণত, ২ বা ৩টা গ্রহের এক লাইনে চলে আসা খুব দুর্লভ কিছু না, কিন্তু যতই এই সারিতে গ্রহের সংখ্যা বাড়তে থাকে, ততই তা আরো দুর্লভ হতে থাকে।
৪ বা ৫ টি গ্রহের একই লাইনে চলে আসতে প্রায় ১৫-২০ বছর সময় লাগলেও সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ একই প্ল্যানেটরি প্যারেডে আসতে সময় লেগে যায় প্রায় ১৬০-২০০ বছর।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে মার্চের শুরু নাগাদ এই প্যারেডে যোগ দেবে আরো এক সদস্যঃ বুধ (Mercury)। ১২ই মার্চ শনি গ্রহ সূর্যের অন্যপাশে হারিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত দেখা যাবে এই প্ল্যানেটরি প্যারেড।
বাংলাদেশ থেকে এই ঘটনা খালি চোখে দেখতে পারার সম্ভাবনা কম, তবে আপনি আলো দূষণ মুক্ত জায়গায় থেকে চেষ্টা করলে খালি চোখেই ৫ টা গ্রহ (বুধ, শুক্র, মঙ্গল, শনি আর বৃহস্পতি) দেখতে পাবেন বলে আশা করা যায়।

ইউরেনাস আর নেপচুনের দুরত্ব অনেক অনেক বেশি হবার কারণে খালি চোখে তাদের দেখতে পারাটা একটু কঠিনই হবে, তবে আপনার কাছে মোটামুটি মানের একটা টেলিস্কোপ থাকলে আপনি আপনার বাসায় বসেই এই চমৎকার ঘটনা উপভোগ করতে পারবেন।
এই গ্রহদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল দেখা যাবে শুক্র (Venus) গ্রহকে। সূর্যাস্তের ঠিক পর পরই ডুবন্ত সূর্যের একটু ওপরে সাঁঝবাতির মত আলো ছড়াতে থাকবে গ্রহটি।
ফেব্রুয়ারি এগিয়ে চলার সাথে সাথে পৃথিবীর আরো কাছে চলে আসবে শুক্র, আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকবে তার উজ্জ্বলতাও।
এই প্ল্যানেটরি প্যারেডে তার ঠিক পরের অবস্থানেই থাকবে শনি (Saturn)। শুক্রের ঠিক নিচের দিকেই দেখা যাবে আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে উজ্জল আর সুন্দর বলয় (Ring) এর মালিক এই গ্রহকে।
তবে আমাদের থেকে তার দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় শুক্রের মত উজ্জ্বলভাবে তাকে আমরা দেখতে পাবো না
এমনকি তার সেই চমৎকার বলয়গুলোও খালি চোখে আমাদের কাছে ধরা দেবে না। সেগুলো দেখতে হলে আপনার কাছে অন্তত ৩০ গুন ম্যাগনিফিকেশন পাওয়ারের টেলিস্কোপ বা দূরবীন থাকতে হবে।
দিন গড়ানোর সাথে সাথে বাড়তে থাকবে শুক্র আর শনি গ্রহের মধ্যেকার দুরত্ব, আর ফেব্রুয়ারির শেষে শনি একবারেই হারিয়ে যাবে সূর্যের অন্য পাশে।
লাইনে তার পরের কুতুব হচ্ছেন গ্রহরাজ বৃহস্পতি(Jupiter)। রূপালি-সাদা আলোর ঝিলিক নিয়ে আমাদের আকাশে আসবেন আমাদের সৌরজগতে সূর্যের পরেই সবচেয়ে বড় গ্যাস জায়ান্ট। একে দেখা যাবে শুক্র আর শনির দক্ষিণ দিকে, সন্ধ্যার পর পর।
ভালো মানের টেলিস্কোপ বা দূরবীন থাকলে গ্রহরাজের সাথে আরো দেখা পাওয়া যাবে তার চার মন্ত্রীর তিন জনেরও।
ফেব্রুয়ারির ২৫ আর ২৬ তারিখে জায়গামত চোখ রাখলে বৃহস্পতির খুব কাছেই দেখতে পাওয়া যাবে তার চার উপগ্রহের তিনটিঃ ইউরোপা (Europa), গ্যানিমিড (Ganymede), আর ক্যালিস্টো (Callisto) কে।
তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে এই অপরূপ দৃশ্য দেখা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশে বসে এমন দৃশ্য দেখতে চাইলে আপনার সাহায্য নিতে হবে স্কাই টুনাইট (Sky Tonight) নামের এক বিশেষ অ্যাপের, যেখানে ঘরে বসেই আপনি মহাকাশের নানান জিনিসপাতির সঠিক লোকেশন ট্র্যাক করতে পারবেন।

এবার চলে আসতে হবে আকাশের মাধামাঝিতে। কমলা-হলুদ রঙের আলোয় আপনাকে স্বাগত জানানোর জন্য সেখানে অপেক্ষা করবে মঙ্গল (Mars) গ্রহ।
সারা রাত ধরেই দেখা যাবে এই গ্রহকে, সাথে অবশ্য আরো দেখা পাবেন দূর আকাশের আরো কিছু নক্ষত্রেরও। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পোলাক্স (Pollux) আর ক্যাস্টর (Castor) নামের এক জোড়া নক্ষত্র।
এর পরের অবস্থানে থাকবে বুধ (Mercury): আমাদের সৌরজগতের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকেই অল্প কিছুদিনের জন্য দেখা যাবে বুধকে। আর চলে যাবার আগে শনি গ্রহের ডানপাশ দিয়ে চলে যাবে সূর্যের আড়ালে।
খালি চোখে বাকি গ্রহদের দেখা বেশ কঠিনই হবে, যদি না আপনার দৃষ্টিশক্তি চমৎকার হয়, আকাশ একদম পরিষ্কার থাকে, আর আপনি জানেন ঠিক কোথায় তাদের খুঁজতে হবে।
তবে ভালো মানের টেলিস্কোপ বা দুরবীন ব্যবহার করে আপনি সহজেই বাকি দুই সদস্যঃ ইউরেনাস (Uranus) আর নেপচুনকে (Neptune) সন্ধ্যা পরবর্তী আকাশে খুঁজে বের করতে পারবেন। আর সাথে যদি থাকে তারার ম্যাপ বা অ্যাটলাস, তাহলে এদের খুঁজে বের করা আরো সহজ হয়ে যাবে।
তবে সারা মাস ধরে সন্ধ্যার আকাশে চোখ রাখার মত সময় আপনার হাতে না থাকলে শুধু ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে ফোকাস করলেই চলবে। অমাবস্যার থাকায় সেদিন কোন ঝামেলা ছাড়াই খুব সুন্দরভাবে দেখে ফেলতে পারবেন এই প্ল্যানেটরি প্যারেড।
তাই, এই দিনে শক্তিশালি দূরবীন বা ছোট্ট টেলিস্কোপ হাতে বেড়িয়ে পড়ুন শহরের আলো দূষণ থেকে দূরের কোন মুক্ত আকাশের নিচে, আর উপভোগ করুন আমাদের সৌর পরিবারের সব গ্রহদের দুর্লভ এই মিলনমেলা।
তবে সত্যি সত্যি কিন্তু গ্রহগুলো সব এক লাইনে আসবে না। আমাদের সৌরজগৎ গঠন হবার সময় সব ধূলা আর গ্যাসের মেঘ প্রায় একটা সরলরেখায় ছিল, আর তাই তারা সূর্যকে কেন্দ্র করে মোটামুটি একটা সরলরেখা বরাবরই প্রদক্ষিণ করে।
এই কাল্পনিক রেখাটার নাম দেয়া হয়েছে “ইক্লিপ্টিক (Ecliptic)”, আর সব প্ল্যানেটরি প্যারেডের সময়ই গ্রহগুলো কমবেশি এই লাইনের কাছাকাছিই থাকে।
কিন্তু এই প্ল্যানেটরি প্যারেড কেন হয়?
আসল কাহিনি হচ্ছে সূর্যের চারদিকে গ্রহগুলোর আবর্তনের সময়। সূর্যের কাছাকাছি থাকা গ্রহগুলোর সূর্যের চারিদিকের একবার ঘুরে আসতে সময় কম লাগলেও (বুধ -- ৮৮ দিন, পৃথিবী -- ৩৬৫ দিন) দূরের গ্রহগুলোর এতে অনেক সময় লেগে যায় (নেপচুন -- ৬০ হাজার দিন বা ১৬৫ বছর)।
ফলে কয়েকশ বছর পর পর গ্রহগুলো প্রায় এক লাইনে কাছাকাছি চলে আসে। পৃথিবীর আকাশে থেকে সবগুলো গ্রহকেই একসাথে “ইক্লিপ্টিক” এর আশে পাশে দেখা যায়, আর এটাকেই আমরা নাম দিয়েছি প্ল্যানেটরি প্যারেড।
প্ল্যানেটরি প্যারেড শুধু যে এক চোখ ধাঁধানো দৃশ্য উপহার দেয়, তা-ই নয়, এটি মহাকাশপ্রেমীদের জন্য এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা
এই ধরনের ঘটনা শুধু মহাকাশপ্রেমিদের নয়, উৎসুক করে তোলে মহাকাশ বিজ্ঞানীদেরও। তারা বিশেষ টেলিস্কোপ দিয়ে সব গুলো গ্রহ দেখেন, আর তাদের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে উদ্ঘাটন করেন আমাদের সৌরজগৎ সম্পর্কে নানা অজানা তথ্য।
যারা টেলিস্কোপ বা দূরবীন হাতে নিয়ে রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য এটি এক দারুণ সুযোগ।
পরেরবার আমাদের পৃথিবী সহ সৌরজগতে সব গ্রহদের একই লাইনে দেখা যাবে ২১৬১, ২১৭৬, আর ২৪৯৬ সালে। তবে এই বছরের শেষের দিকে, ২০৪০ আর ২০৮০ সালে আমরা ৫ আর ৬ গ্রহের প্ল্যানেটরি প্যারেডও দেখতে পাবো।
যদিও বাংলাদেশ থেকে খালি চোখে সব গ্রহ দেখা সম্ভব নাও হতে পারে, তবুও কিছুটা চেষ্টা করলে আর সঠিক সময় নির্বাচন করলে শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি ও বুধ গ্রহের ঝলমলে উপস্থিতি উপভোগ করা যাবে।
বিশেষ করে ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখের মতো নির্দিষ্ট দিনে, অমাবস্যার অন্ধকার আকাশে আরও ভালোভাবে এই মহাজাগতিক প্রদর্শনী আমাদের চোখে ধরা দেবে।
তাই, আপনি যদি রাতের আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান, তবে এই প্ল্যানেটরি প্যারেড মিস করা উচিত নয়।
দূরবীন হোক বা খালি চোখ, এই মহাজাগতিক মিলনমেলা আমাদের সৌরজগতের এক অনন্য বিস্ময়, যা চিরকাল আমাদের কৌতূহল আর বিস্ময়ের খোরাক জুগিয়ে যাবে।
তথ্যসুত্রঃ
তথ্যসুত্রঃ
- See a 'parade' of 6 planets fill the sky on Saturday night — before a bonus 7th planet joins in March | Live Science
- Planetary parade February 2025: When, where and how to see it | Space
- Planetary Alignment | Planets Aligning 2025 | All Planets In One Line | Planetary Parade | Star Walk
- Planetary alignment 2025 | BBC Sky at Night Magazine
- Planetary alignment 2025: This is what it really means when seven planets line up in the sky
- Planetary Parade 2025: Here's how to catch the rare seven-planet alignment - CNBC TV18
Comments
Post a Comment