১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই মানব ইতিহাসের এক উজ্জ্বল মাইলফলক। এদিনে পৃথিবীর মানুষ প্রথম পা দেয় চাঁদের বুকে, আর সূচনা করে স্পেস এজ এর।
যদিও এপোলো ১১ মিশনের মূল উদ্দ্যেশ্য ছিলো তৎকালীন স্নায়ুযুদ্ধে (Cold War) প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে টেক্কা দেয়া, কিন্তু এই ঘটনার মাধ্যমেই মানবজাতি সর্বপ্রথম পৃথিবীর গন্ডি পেরিয়ে মহাশূন্যের অসীম পথে যাত্রা শুরু করে।
তবে বেশ বড় সংখ্যক মানুষের মনে এ নিয়ে সন্দেহ কাজ করে যে, মানুষ কি আসলে চাঁদে কখনো পা রেখেছে?
এই ডিজিটাল ইনফরমেশনের যুগেও চন্দ্রাভিযান নিয়ে রয়েছে নানা কন্সপিরেসি থিওরি।
তাই আজ চলুন সমাধান করে আসি এই সমস্যাটির। খুঁজে বের করি মানুষ আসলেই চাঁদে গিয়েছিলো কি না।
চন্দ্রাভিযান মিশনের বিস্তারিত বর্ণনায় আজ যাচ্ছিনা, সেটা নিয়ে অন্য একদিন কথা বলা যাবে। আজ আমরা মূলত দেখবো কি কি কারনে “চাঁদে কখনও মানুষ যায় নি” কিংবা “সব নাসার ভাওতাবাজি” বলা যুক্তিগুলো খাটে না।
আমরা চাঁদে মানুষ যাবার কিছু প্রমাণও ঘুরে দেখবো। আশা করছি এতে সবার সন্দেহ দূর হবে।
তবে চলুন, শুরু করি আমাদের এডভেঞ্চার
প্রথমেই আসি এপোলো ১১ মিশনের রিসোর্স এ।
এই মিশনে ব্যবহার করা হয় একটি Saturn V রকেট, যেটা বানাতে খরচ হয়েছিলো ১৮৫ মিলিয়ন ইউ এস ডলার ( আজকের দিনে ১.২ বিলিয়ন ডলারের বেশি), চার লাখেরও বেশি মানুষ কাজ করেছে এই রকেট বানাতে, লেগেছে অসংখ্য ব্লুপ্রিন্ট।
এগুলোর অনলাইন কপির একটা অংশ পাবলিক্যালি অনলাইনে পাওয়া যায়, আপনি নিজেও চাইলে চেক করে দেখতে পারেন এখান থেকে।
একটা সহজ লজিক বলি, আপনি যদি কাউকে তথ্য গোপন রাখতে টাকা দেন, তাহলে কিন্তু এমন কোন গ্যরান্টি নাই যেই সেই ব্যক্তি কিছুদিন পর আপনার গোমর ফাঁস করে দেবে কি না।
তাই না?
এখন যদি বলেন নাসা যদি ৪০০,০০০ জন মানুষ, তাদের পরিবার এবং পরবর্তী জেনারেশনগুলোরে ৫০ বছরেরও বেশী সময় ধরে টাকা দিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছে, তাহলে সেই ধারনাটার কোন বাস্তব ভিত্তি থাকে না।
চন্দ্রাভিযান নিয়ে আরো কিছু কন্সপিরেসির জবাব দেবো, তবে তার আগে চাঁদে যে আসলেই মানুষ গিয়েছিলো তার কিছু প্রমান দেখে আসি।
আমাদের প্রথম প্রমান হচ্ছে রেট্রো রিফ্লেক্টর।
এপোলো — ১১, ১৪, এবং ১৫ মিশনের নভোচারীদের প্রতি নির্দেশ ছিলো যাতে তারা চাঁদের মাটিতে কিছু নির্দিষ্ট যায়গায় বিশেষ “রেট্রো রিফ্লেক্টর” বসিয়ে আসেন। এদের কাজ হচ্ছে পৃথিবী থেকে পাঠানো লেজার রশ্মি প্রতিফলন করে আবার পৃথিবীতে পাঠানো।
এখন বলতেই পারেন এগুলো হচ্ছে বেহুদা খরচ। কিন্তু না, এটা মোটেও বাজে খরচ ছিলো না।
এই রিফ্লেক্টরগুলো থাকার কারনেই আমরা যে কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব সঠিকভাবে মাপতে পারি। এদের কারনেই আমরা এখন জানি চাঁদ প্রতি বছর প্রায় দেড় ইঞ্চি পরিমানে দূরে সরে যাচ্ছে আমাদের পৃথিবী থেকে।
এই এক্সপেরিমেন্টটাকে বলা হয় Lunar Laser Ranging Experiment (LLRE)।
এর জন্য আপনার দরকার হবে একটা হাই পাওয়ার লেজার, একটা মিডিয়াম রেঞ্জের টেলিস্কোপ, একটা স্টপওয়াচ, আর একটা ক্যালকুলেটর।
তবে এটা নিজের বাসায় করতে যাবেন না যেন। হাই পাওয়ার লেজার লাইট চোখের জন্য মারাত্মক বিপদজনক।
পরীক্ষাটি কিভাবে করা হয় দেখে নিতে চাইলে চোখ রাখুন নিচের ভিডিওটিতে —
এতো গেল পরীক্ষার কথা। চন্দ্রাভিযানের আরেকটা বড় প্রমান হচ্ছে চাঁদ থেকে আনা মাটি আর পাথর। চাঁদের মাটির সাথে আমাদের পৃথিবীর মাটির মিল নেই।
চাঁদের মাটি রেডিও একটিভ, অর্থাৎ তেজস্ক্রিয়; আর তাতে পাথর আর ধুলা ছাড়া আর কিছু নেই।
আমাদের পৃথিবীতে মহাকাশ থেকে আসা ধুলোর কণাগুলো বায়ুমণ্ডলে বাতাসের কণার সাথে ধাক্কা খেতে খেতে মসৃণ হয়ে যায়।
অন্যদিকে, চাঁদে বায়ুমণ্ডল না থাকায় সেখানকার ধূলিকণাগুলো হয় অনেক তীক্ষ্ণ আর সুচালো। নিঃশ্বাসের সাথে এই ধূলা ফুসফুসে ঢুকলে সেটা মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।
তো চাঁদের থেকে নিয়ে আসা এই স্যম্পল আপনি নিজেই দেখে আসতে পারেন, যা কিনা রাখা আছে টেক্সাস, আমেরিকার জনসন স্পেস সেন্টারে।
কেউ কেউ আবার প্রশ্ন তোলেন ভ্যান এলেন (Van Allen) বেল্ট নিয়ে। এটা হচ্ছে একাধিক স্তরবিশিষ্ট একটা চার্জড পার্টিকেল এর অঞ্চল। নিচের ছবিতে ভ্যান এলেন (Van Allen) বেল্ট দেখানো হল
তাদের কথা হচ্ছে,
এই বেল্টের রেডিয়েশনে তো নভোচারীরা মারা যাবার কথা।
তাদের যুক্তিতে সমস্যা হচ্ছে তারা রকেটের গতির ব্যাপারটা ভুলে যান।
বায়ুমন্ডল ছেড়ে বের হবার পর প্রতি মুহূর্তেই বেগ বাড়তে থাকে রকেটের। ফলে খুব দ্রুতই এই অঞ্চল ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে পারেন নভোচারীরা, কোন রকমের সিরিয়াস ক্ষতির আশঙ্কা ছাড়াই।
ঠিক যেমন জ্বলন্ত শিখার ওপর দিয়ে আপনি খুব সহজেই আপনি আঙুল নিয়ে যেতে পারবেন, যদি আপনি কাজটি চটজলদি সেরে ফেলতে পারেন।
এবার আসুন চন্দ্রাভিযানের কিছু ছবি দেখি আর এ সংক্রান্ত কিছু ভুল ধারণা দূর করিঃ
প্রথমেই আছে চন্দ্রাভিযানের সবচেয়ে বড় সমালোচনার জন্মদানকারী ছবিটি। এখানে দেখা যাচ্ছে, নভোচারী বাজ অল্ড্রিন মার্কিন যুক্তরাজ্যের একটা পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
দেখে মনে হচ্ছে পতাকাটি বাতাসে উড়ছে।
কিন্তু চাঁদে তো কোন বায়ুমণ্ডল নেই, তাহলে বাতাস এলো কোথেকে?
এই প্রশ্নটার উত্তর আসলে খুব সহজ। এখানে কিন্তু পতাকাটি আমাদের পৃথিবীর মত সুতা দিয়ে বাঁধা হয় নি, সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে এক বিশেষ ধরনের টেলিস্কপিক স্ট্যান্ড, যা পতাকাটাকে মেলে ধরতে সাহায্য করছে।
আর যেটা দেখে মনে হচ্ছে কাপড়ের দোল, সেটা আসলে ভাঁজ হয়ে থাকা কাপড় ছাড়া আর কিছুই না।
এবার আসি দুই নম্বর ছবিতে। এখানে দেখা যাচ্ছে, বাজ অল্ড্রিন এর ভাইসর। সূর্যের তীব্র আলো থেকে বাঁচতে এই ভাইসরে লাগান হয় রিফ্লেক্টিভ কোটিং। যার ফলে এতে আশেপাশের সব কিছুর রিফ্লেকশন দেখা যাচ্ছে।
তো এই রিফ্লেকশনে দেখা যায় একটা মানুষের ছায়া, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নীল আর্মস্ট্রং আর ছবিতে দেখা বাজ অলড্রিন।
কিন্তু চাঁদে তো মানুষ নেমেছিলো মাত্র ২ জন।
- তবে ছায়াটা কার?
- আর ছবিটাই বা তুললো কে?
- ক্যামেরাটাই বা কই?
এর জবাবও খুব সোজা। আজকের দিনে মানুষ যেমন সেলফি স্টিক ব্যবহার করে। এখানেও তাই করা হয়েছে।
তবে ক্যামেরাটা এখানে কোন সেলফি স্টিকে না, বরং বাজ অলড্রিনের স্পেস স্যুটের সাথে লাগানো ছিলো। ছায়াটা এখানে বাজ অলড্রিনেরই।
এই পরের ছবি বোকা বানিয়েছে অনেক জনকেই। এখানে দেখা যায় মহাশূন্যের যায়গায় ঘন কালো অন্ধকার ছাড়া তো আর কিছুই নেই।
কিন্তু মহাকাশে তো অসংখ্য তারা থাকার কথা। তো ছবিতে তারা নেই কেন?
ক্যামেরা বা লেন্স নিয়ে যারা কাজ করেন, এটা তারা সহজে বুঝতে পারবেন। ছবিটা এখানে দিনের বেলায় তোলা হয়েছে, তার মানে আসে পাশে সূর্যের আলোর তেজ বেশ প্রখর।
আবার নভোচারীর গায়ে থাকা সাদা স্পেসস্যুট আলো প্রতফলন করে তার তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমন অবস্থায় দুরের আকাশের বিন্দু বিন্দু তারারা ক্যামেরার লেন্সে নিজেদের অবস্থান জানানোর মত শক্তিশালী হয় না।
এ অবস্থায় ছবি তোলার জন্য ক্যামেরার শাটার স্পিড হতে হয় অনেক দ্রুত, আর ব্যবহার করতে হয় খুব ছোট এপারচার। যার ফলে বিন্দু বিন্দু তারাদের দেখা যায় না।
এর পরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাজ অল্ড্রিন লুনার মডিউল থেকে নামছেন। কন্সপিউরেসী থিওরীস্টরা যুক্তি দেন,
চাঁদে সূর্য ছাড়া আর কোন লাইট সোর্স নেই, তাইলে সূর্যের ছায়ায় থাকা বাজ অল্ড্রিনকে কিভাবে দেখা যাচ্ছে?
এই প্রশ্নের উত্তরও সারপ্রাইজিংভাবে খুবই সোজা। চাঁদে আলোর প্রাইমারি সোর্স সূর্য হলেও এই ছবিটার মধ্যে থাকা অধিকাংশ জিনিসই সূর্যের আলো প্রতিফলন করছে।
চাঁদের মাটি, লুনার মডিউল, আর পৃথিবী থেকে পাওয়া আলোর সাহায্যেই আমরা এখানে অন্ধকারে থাকা মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছি।
সর্বশেষের ছবিটায় একটা লেন্স ফ্লেয়ার দেখা যায়। যারা লেন্স নিয়ে কাজ করেন নাই তারা এটা দেখে কনফিউজড হয়ে যান। কিছু মানুষ বলে,
ফ্লেয়ার তখনি হয় যখন একাধিক আলোর উৎস থাকে।
তারা এটা বলে বোঝাতে চান যে মুন ল্যান্ডিং এর নাটক কোন স্টুডিওতে করা হয়েছে, যার ফলাফল হচ্ছে ফ্লেয়ার।
এখন সবার হাতেই স্মার্টফোন আছে। ছবি তোলার সময় নিশ্চই খেয়াল করেছেন যে আলোর উৎস তীব্র হলেই সেখানে লেন্স ফ্লেয়ার দেখা যায়। এর জন্য একাধিক সোর্স লাগে না।
আর নাসা যদি এতো টাকা খরচ করে মুন ল্যান্ডিং এর নাটক করেই থাকে, তবে, এই ছবি পাবলিশ করার মানে কি?
তারা তো চাইলেই এডিট করে আরো ভালো ছবি দিতে পারতো, তাই না?
সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, নাসা যদি মুন ল্যান্ডিং এর নাটক করতেও চাইতো, তাহলেও সেই সময়ের প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই নাটক বানাতে খরচ পড়তো পুরো এপোলো -১১ মিশনের চাইতেও বেশি।
এই মিশনের ছবিগুলো ভালো করে খেয়াল করলে যেখা যায়, এখানের সব ছায়াগুলো একে অপরের সমান্তরাল। স্টুডিও লাইট দিয়ে তেমন পরিবেশ তৈরি করা তখনকার দিনে প্রায় অসম্ভবই ছিলো বলা যায়।
চন্দ্রাভিযান মিথ্যে হলে যাদের লাভ সবচেয়ে বেশি, সেই রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত শেষমেশ একমত হয়েছেন যে মানুষ আসলেই চাঁদে গিয়েছে, এখানে নাসার কোন ছলচাতুরী নেই।
তাদের সাথে আরো একমত হয়েছেন অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, আর ইংল্যান্ড সহ দুনিয়ার নানান প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিজ্ঞানীরাও।
এতোকিছুর পরেও আপনার সন্দেহ না কেটে থাকলেও এবার তা কেটে যাবে নিশ্চিত। আগামীতে মানুষ আবার যাবে চাঁদে। সবকিছু ঠিক থাকলে আর্টেমিস — ২ নামের এ মিশনে চার জন নভোযাত্রী চাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন খুব জলদি।
আর আপনিও মেনে নিতে বাধ্য হবেন যে মানুষ চাঁদ কেন, আরো অনেক কিছুই জয় করার সক্ষমতা রাখে, যদি তার ফোকাস সঠিক যায়গায় থাকে।
Comments
Post a Comment