দুধ কি আসলেই আমাদের আদর্শ খাদ্য, নাকি স্রেফ সাদা বিষ?
গত কয়েক দশকে দুধ একটা বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ বলে, দুধ একটা দরকারী পুষ্টিকর খাবার যা কিনা স্বাস্থ্যকর হাড়ের গঠনের জন্য অপরিহার্য।
আবার আরেক দল বলে,
দুধ থেকে ক্যান্সার হতে পারে এবং এটা সম্ভবত আমাদের অকালমৃত্যুর একটা কারণ
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন দলের দাবী সঠিক?
আর, আমরা দুধ কেনইবা পান করি?
আসুন জেনে নেয়া যাক...
দুধ হচ্ছে সব ধরনের স্তন্যপায়ী প্রানীর ন্যাচারাল ডায়েটের (খাবার) অংশ। জন্মের পর আমাদের প্রথম পুষ্টি আমরা দুধ থেকেই পেয়ে থাকি।
এই সময়ে আমাদের পরিপাক তন্ত্র ছোট আর দুর্বল থাকে। জটিল খাবার খেয়ে হজম করার মত অবস্থা আমাদের থাকে না। তখন মায়ের দুধ স্তন্যপায়ী প্রানীর শরীরের যাবতীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে থাকে।
বেসিক্যালি, দুধ হচ্ছে একটা “পাওয়ার ফুড” যা কিনা আমাদের শরীরকে সচল হবার জন্য দরকারী শক্তি দেবার পাশাপাশি আমাদের দ্রুত বেড়ে উঠতেও সাহায্য করে।
দুধের মধ্যে প্রচুর পরিমানে স্যাচুরেটেড ফ্যাট (Saturated Fat), ভিটামিন, মিনারেল আর মিল্ক-স্যুগার রয়েছে, যার নাম ল্যাক্টোজ।
এছাড়াও জন্মের পর কিছু সময়ের জন্য দুধে এন্টিবডি আর প্রোটিন ও পাওয়া যায়। এই সময় দুধটা খানিকটা গাঢ় আর হলদে হয়, আর একে আমরা “শালদুধ” নামে চিনি।
এই এন্টিবডি আর প্রোটিন আমাদের ছোট্ট শরীরটাকে নানা ধরনের ইনফেকশন থেকে বাঁচায় আর আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে (Immune System) শক্তিশালী করে।
সময়ের সাথে সাথে স্তন্যপায়ী প্রানীরা মায়ের দুধ ছেড়ে অন্যান্য কমপ্লেক্স খাবার খাওয়া শুরু করে।
গত কয়েক লাখ বছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ১১ হাজার বছর আগে এমন কিছু ঘটে যায় যা আগে কখনো হয় নি।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা মানব ইতিহাসের প্রথম কৃষিনির্ভর সমাজে বসবাস শুরু করে। তার কিছু সময় পরেই তারা প্রথম গবাদিপশু পোষ মানাতে শেখে। এদের মধ্যে দুধ দেয় এমন প্রানীও ছিলো, যেমন গরু,মহিষ, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি।
জলদিই তারা আবিষ্কার করলো, আশেপাশের ছড়ানো ছিটানো ইউজলেস জিনিস (ঘাস) এই সব স্তন্যপায়ী গৃহপালিত প্রানীকে খেতে দিলে তারা সেটাকে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর পানীয়তে (দুধ) পরিণত করতে পারে।
মজার বিষয় হচ্ছে, প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষেত্রে এক বিশাল সুবিধা দিল এই পানীয়। বিশেষত, শীতকালে, যখন খাবারের সংকট দেখা দিত।
সুতরাং যেসব গোষ্ঠির কাছে দুধ সহজলভ্য ছিলো তারা বিবর্তনের ক্ষেত্রেও একটা এক্সট্রা সুবিধা পেল। আর যেসব গোষ্ঠী প্রচুর পরিমানে দুধ পান করত, ন্যাচারাল সিলেকশনের মাধ্যমে আস্তে আস্তে তাদের জিনের মধ্যেও পরিবর্তন এলো।
এই পরিবর্তনের পেছনে একটা বিশেষ ধরনের এনজাইমের হাত আছে। এই এনজাইমের নাম হচ্ছে ল্যাক্টেজ। বাচ্চাদের দেহে এই এনজাইম প্রচুর পরিমানে থাকে। তাই তারা ল্যাক্টোজ নামের মিল্ক স্যুগার খুব সহজেই হজম করতে পারে।
কিন্তু আমরা যতই আস্তে আস্তে বড় হতে থাকি ততই আমাদের শরীর এই ল্যাক্টেজ নামের এনজাইমের উৎপাদন কমাতে থাকে। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, সারা বিশ্বের প্রায় ৬৫% মানুষের শরীরেই প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর এই এনজাইম আর থাকে না।
এর মানে হচ্ছে, এই সব মানুষেরা প্রতিদিন ১৫০ মিলি লিটারের বেশি দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার খেলে তা হজম করতে পারে না।
ডাক্তারী ভাষায় যাকে “ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্স” বলে
পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায় যে, এই “ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্স” দুনিয়ার সব জায়গায় সুষমভাবে ছড়ানো নেই। কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষ অন্যদের চেয়ে দুধ হজম করায় বেশি দক্ষ।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে এই “ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্স” এর হার সবচেয়ে বেশী, কিছু কিছু জায়গায় সেটা ৯০% পর্যন্তও হয়। উত্তর আমেরিকা আর উত্তর ইয়োরোপের দিকে এই হার সবচেয়ে কম।
এই দুধ হজম করার যে স্পেশাল ক্ষমতা সেটা কিন্তু শুরুতে বিভিন্ন গোত্রের মানুষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে র্যান্ডম মিউটেশনের মাধ্যমেই উদ্ভব হয়েছিল।
কিভাবে? আসুন জেনে নেই...
কৃষির আবিষ্কারের পর একে একে সব গোষ্ঠিই অনিশ্চিত আর ঝুঁকিপূর্ণ শিকারের কাজ ছেড়ে তুলনামূলক সহজ আর নিরাপদ কৃষিকাজের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে একটা ন্যাচারাল সিলেকশন প্রেশার তৈরি হয়।
এটা আবার কি জিনিস, তাই না?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যেসব বাহ্যিক উপাদানের কারণে কোন জীবের তাদের পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতার পরিবর্তন হয় তাদের সিলেকশন প্রেশার বলে।
যেমন ধরেন, কোন এলাকায় যদি যদি হঠাৎ করে শিকারী পাখি বেড়ে যায় আর তারা বেছে বেছে উজ্জ্বল রঙের পোকামাকড় খেয়ে ফেলতে শুরু করে, তাহলে কিছুদিন পর দেখা যাবে উজ্জ্বল রঙের পোকামাকড়ের সংখ্যা কমে গেছে।
ফলে যেসব পোকামাকড়ের গায়ের রঙ উজ্জ্বল না, তারা বেঁচে থাকার জন্য একটা এক্সট্রা সুবিধা পাবে। তারাই বেশি করে বংশবিস্তার করবে আর কিছুদিন পর সেই এলাকায় গাঢ় বা অনুজ্জ্বল রঙের পোকামাকড় দিয়ে ভরে যাবে।
এই যে গাঢ় বা অনুজ্জ্বল রঙের পোকামাকড় বেশি বেশি বংশবিস্তার করার সুযোগ পেল, এটা এক ধরনের সিলেকশন প্রেশার।
এবার তবে ফেরত আসা যাক আমাদের গল্পে।
কৃষির আবিষ্কারের পর যে সব মানুষ ল্যাক্টোজ হজম করতে পারতো, তাদের কাছে এভেইলেবল খাবারের পরিমান বেশি ছিলো। এটা ছিলো তাদের জন্য বড় একটা প্লাস পয়েন্ট।
ডেইরি ফার্মারেরা যখন পৃথিবীর উত্তর দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তখন তাদের সাথে সাথে এই বৈশিষ্ট্যটাও উত্তরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ও সংখ্যায় বাড়তে থাকে।
ধারণা করা হয় যাদের এই বৈশিষ্ট্য ছিলো না তারা উত্তরাঞ্চল থেকে আস্তে আস্তে সরে যেতে বাধ্য হয়।
এসব তো গেল ইতিহাস। এখন কথা হচ্ছে, দুধ আমাদের খাদ্য তালিকার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হিসেবে আছে প্রায় কয়েক হাজার বছর ধরে।
তাহলে এখন এটা নিয়ে এতো বিতর্ক কেন উঠছে?
আসল ঘটনা হচ্ছে, মানুষের শরীরে দুধের পজেটিভ আর নেগেটিভ ইফেক্ট নিয়ে বেশ কিছু দাবী আছে। নেগেটিভ দাবীগুলোর সীমানা আবার অনেক ব্যাপক।
একদম সাধারণ এলার্জি থেকে শুরু করে ইনটলারেন্স, হাড় ভঙ্গুর করে দেয়া, হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীর নানা রোগ বাঁধানো এমনকি ক্যান্সার --- সবই আছে এসব দাবীর মধ্যে।
এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, এমন দাবীর সত্যতা ঠিক কতটুকু?
আবার, তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে এসে মানুষ জানতে আর বুঝতে শুরু করলো, দুধ আসলে আদর্শ খাদ্য নয়, অন্য দশটা সাধারণ খাবারের মতই একটা খাবার।
তখন তাদের মধ্যে প্রশ্ন জাগলো,
তাহলে দুধকে আদর্শ খাদ্য হিসেবে প্রচার করা শুরু করলো কে?
নানা দেশের সরকার তাদের ডেইরি ইন্ডাস্ট্রিকে রক্ষা করার জন্য নানা ধরনের প্রতারণামুলক প্রচারণার মাধ্যমে দুধকে সবার সামনে “মহান” করে তোলার জন্য নানা চেষ্টা তদবীর করা শুরু করে।
এসব নিয়ে বিস্তারিত পাবেন নিচের ভিডিওতেঃ
এবার চলেন কথা বলি দুধের নেগেটিভ প্রভাব নিয়ে।
বেশ কিছু প্রাচীন গবেষণায় দুধের সাথে কোলন, ব্রেস্ট আর প্রস্টেট ক্যান্সারের সম্পর্ক পাওয়া গেছে।
কি ভাই, কলজে শুকিয়ে গেল?
আপনার শুকনো কলিজা ভেজাতে এক গ্লাস দুধ ঢক ঢক করে মেরে দিতেই পারেন। কারণ মেটা এনালাইসিসে দুধের সাথে ক্যান্সারের কোন যোগসূত্র পাওয়া যায় নি।
এখন মাথা চুলকে নিশ্চয়ই ভাবছেন,
- এই মেটা এনালাইসিস জিনিসটা আবার কি রে বাবা?
- এটা খায় না মাথায় দেয়, তাই না?
সোজা বাংলায়, মেটা এনলাইসিস হচ্ছে এমন একটা পরিসংখ্যানগত গবেষণা যেটাতে অনেকগুলো সায়েন্টিফিক স্টাডির ফলাফল তুলনা করা হয়।
সেসব যায়গায় সাধারনত মেটা এনলাইসিস করা হয় যেখানে একই প্রশ্ন/বিষয়ের ওপর অনেকগুলো সায়েন্টিফিক স্টাডি করা হয়েছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে যে তাদের মধ্যে কিছুটা ভুল রয়ে গেছে।
তাছাড়াও একেক গবেষণায় যদি একেকরকম রেজাল্ট আসে তাহলে সেক্ষেত্রেও মেটা এনলাইসিস করা হয়ে থাকে অনেকগুলা রেজাল্ট পর্যালোচনা করে একটা সাধারণ রেজাল্ট প্রকাশ করার জন্য।
তো এই মেটা এনালাইসিস অনুযায়ী, দুধের কারনে ক্যান্সার তো হয়ই না, বরং দুধের মধ্যে থাকা ক্যালসিয়াম হয়তো কোলন ক্যান্সারের বিপক্ষে আপনাকে খানিকটা সুরক্ষাও দিতে পারে।
কিন্তু এই সুরক্ষা আপনি সাধারণ ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট থেকেও আপনি পাবেন, এখানে দুধের আদৌ কোন ক্রেডিট আছে কি না সেটা ক্লিয়ার না।
আরেকটা গবেষণায় দেখা গেছে যারা সোয়া এক লিটারের বেশি (১.২৫ লি.) দুধ প্রতিদিন পান করেন, তাদের প্রস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি খানিকটা বেশি।
কিন্তু আবারো বলছি,
এই রেজাল্ট কিন্তু প্রত্যেকবার দেখা যায়নি। আবার অন্যান্য গবেষণাতেও এমন রেজাল্ট আসেনি।
মনে রাখবেন, কোন সায়েন্টিফিক স্টাডিতেই একটামাত্র পরীক্ষা করা হয় না। অসংখ্যবার পরীক্ষার পরও যদি সেই সেইম রেজাল্টই বার বার পাওয়া যেতে থাকে, কেবলমাত্র তখনই সেটাকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে।
তাই রিল্যাক্স ব্রো…
এখানে উল্লেখিত সব গবেষণার লিঙ্ক নিচের তথ্যসুত্রে দিয়ে দিচ্ছি, যাতে আপনারাও এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারেন।
সর্বশেষ করা মেটা রিসার্চ অনুযায়ী, আমরা দুধের বা দুধ থেকে তৈরি জিনিসের সাথে আপনার হৃদরোগ, স্ট্রোক বা মৃত্যুঝুঁকির কোন সম্পর্ক পাই নি।
কিছু কিছু গবেষণায় বরং এটা উঠে এসেছে যে, যারা ডেইরী প্রোডাক্ট খান তাদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ তুলনামূলকভাবে কম।
কিন্তু যথেষ্ট প্রমানের অভাবে এটাও আমরা কনফিডেন্সের সাথে ঘোষণা দিতে পারছি না।
তবে এটা বলতে পারি, আপনি যদি প্রতিদিন ১০০ থেকে ২৫০ মি.লি. দুধ পান করেন, তবে দুধের কারনে ক্যান্সার হবার ঝুঁকি নিয়ে আপনাকে না ভাবলেও চলবে।
এবার আসুন তবে হাড়ের দিকে তাকানো যাক
এখানে বিষয়টা আবার একটু জটিল। বেশ কিছু গবেষণা করেও পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য দুধের পজেটিভ বা নেগেটিভ কোন ধরনের ফলাফলই পাওয়া যায় নি।
কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই দুধে থাকা ক্ষতিকর কীটনাশক, হরমোন আর এন্টিবায়োটিকের পরিমান নিয়ে বেশী চিন্তিত থাকেন।
আসলে বিষয়টা হচ্ছে, দুধে হরমোন থাকে ঠিকই কিন্তু সেটা খুবই অল্প পরিমানে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,
একটা পিলের সমপরিমাণ হরমোন (৩৫,০০০ ন্যানোগ্রাম) পেতে হলে আপনাকে মোট ৫০০০ লিটার দুধ পান করতে হবে
আর এই বিশাল পরিমানে দুধ পান করলেও আপনার তেমন কোন ক্ষতি হবে না, শুধু ঘন ঘন টয়লেটে যাওয়া ছাড়া, কারণ বেশিরভাগ হরমোনই আপনার পরিপাক তন্ত্রের কাছে উদুম ক্যালানি খেয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে, আপনার কোন ক্ষতি করার আগেই।
পরিপাক তন্ত্রের এমন ভয়াবহ গুন্ডামির জন্যেই বেশিরভাগ ঔষধ (ক্যাপসুল) প্রোটেকটিভ আবরণে ঢাকা থাকে, যাতে তারা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছানোর আগেই ধ্বংস হয়ে না যায়।
এতোখানি পড়ার পর নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে
দুধ তো তাহলে নিঃসন্দেহে একটা পুষ্টিকর পানীয়, তাই না?
আসলে বিষয়টা এতো সরল নয়। দুধঃ তা সে মানুষ, গরু, ছাগল, ভেড়া, ঊট, মহিষ, যার কাছ থেকেই আসুক না কেন সেটা একটা পুষ্টিকর পানীয়। এর মধ্যে রয়েছে সব ধরনের ম্যাক্রো আর অনেক ধরনের মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট।
কিন্তু দেখতে সাদা এই দুধেরও আছে বেশ কিছু কালো অধ্যায়, যেগুলো আমাদের সবারই ভেবে দেখা দরকার। চলুন তবে দেখে আসি সেগুলো কি কি।
সাদা দুধের কালো অধ্যায়ঃ
প্রথমেই বলতে হয় কীটনাশক আর এন্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে। এটা আসলেই একটা বড় সমস্যা।
তবে সুখবর হচ্ছে, দুনিয়ার অধিকাংশ জায়গাতেই এন্টিবায়োটিক আর কীটনাশকের সর্বনিম্ন ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কড়া আইন রয়েছে ।
উন্নত বিশ্বে যেসব দুধ এই লিমিট ক্রস করে ফেলে সেগুলোকে আর বাজারে ঢুকতেই দেয়া হয় না। সুতরাং সেসব অঞ্চলে বাস করলে আপনার আর তেমন চিন্তা করার কিছু নেই।
বাংলাদেশে থাকলে অবশ্য ভিন্ন কথা
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এলার্জি আর বদহজম বা ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্সে ভোগা বাদে দুধের সবথেকে পরিচিত নেগেটিভ ইফেক্ট হচ্ছে ব্রণ (acne)। এখানে কিন্তু আবার গবেষণার ফলাফল বেশ স্পষ্ট।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, স্কিমড মিল্ক (ফ্যাট/ননী ছাড়া দুধ) ব্রণের হার ২৪% পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে।
আবার, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দুধে এলার্জি বিষয়টা বেশ উল্লেখযোগ্য।
যেমন ধরেন, জার্মানিতে প্রতি ১৮ জন বাচ্চার মধ্যে ১ জন দুধের প্রতি এলার্জিক। সাধারণত বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই এলার্জির প্রকোপ কমতে থাকে।
বিশেষত যেসব অঞ্চলে মানুষকে পর্যাপ্ত পুষ্টি পেতে কষ্ট করতে হয়, সেসব জায়গায় দুধ স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনে এবং শিশুমৃত্যুর হার কমাতে ভালো ভুমিকা রাখে।
উন্নত বিশ্বের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে সাধারণত দুধ ক্ষতিকর না, যদি না আপনার এলার্জি বা ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্সি থাকে। বিশেষত শিশুদের জন্য দুধ সহজে ক্যালসিয়াম পাবার একটা ভালো উপায়।
আবার, ভেগান/ ভেজিটেরিয়ানদের জন্য দুধ ভিটামিন বি কমপ্লেক্স (বিশেষত ভিটামিন বি ১২) এর ভালো একটা উৎস হতে পারে।
কিন্তু তার মানে এই না যে,এসব ভিটামিনের আর কোন বা দুধের থেকেও ভালো কোন উৎস নেই।
স্বাস্থ্যবান / ভালো ছেলে বা মেয়ে হতে চাইলে আপনাকে দুধ খেতেই হবে — বিষয়টা মোটেও এমন নয়
আবার দুধকে কেউ পানির বিকল্প ভেবে বসবেন না যেন। দুধ একটা পাওয়ার ফুড। নিয়মিত অতিরিক্ত পরিমানে দুধ খেলে সেটার এক্সট্রা ক্যালরি আপনার মেদ বাড়িয়ে ফেলতেই পারে।
বিশেষ করে চকোলেট বা অন্যান্য ফ্লেভারড দুধকে দুধ হিসেবে বিবেচনা না করে বরং পেপসি বা ফান্টার মত কোমল পানীয় হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত।
আরেকটা বিষয়, ডেইরী শিল্প কিন্তু আমাদের জলবায়ূর ওপর বেশ নেগেটিভ প্রভাব ফেলে। পৃথিবীতে মোট উৎপাদিত শষ্যজাতীয় পণ্যের প্রায় ৩৩% ই গবাদিপশু লালন-পালনে ব্যবহৃত হয়।
যদিও ১৯৯০ সালের পর থেকে ডেইরী প্রোডাক্টের কার্বন ফুটপ্রিন্টের পরিমান কমে এসেছে, কিন্তু তারপরও সারা বিশ্বের মোট নিঃসরিত গ্রীন হাউজ গ্যাসের ৩% ই আসে ডেইরী শিল্প থেকে, যা কি না গোটা দুনিয়ার সবগুলো প্লেনের মিলিতভাবে নিঃসরিত গ্রীন হাউজ গ্যাসের থেকেও বেশী।
ডেইরী একটা বি-শা-ল বড় ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এই শিল্পের উৎপাদন/পশুপালন ও রক্ষনাবেক্ষণ গবাদি পশুদের জন্য ভয়াবহ ভোগান্তিরও কারণ।
সেটা আবার কেমন? নমুনা দিচ্ছি
মায়েদের তাদের সদ্য জন্মানো বাচ্চার কাছ থেকে জোর করে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। কখনো কখনো বাচ্চাটার কপালে জোটে মায়ের দুধের মাত্র এক চুমুক, বেশিরভাগ সময় তাও জোটে না।
তারপর পাম্প লাগিয়ে একটানা সেই বাচ্চাহারা মায়ের কাছ থেকে তার বাচ্চার জন্য তৈরি হওয়া দুধের শেষ বিন্দুটা পর্যন্ত কেড়ে নেয়া হয়।
মাঝে মাঝে সেই বাচ্চা হারা মায়ের করুন আর্তচিৎকার মাইলখানেক দূর থেকেও শোনা যায়।
এছাড়াও প্রায় প্রতিটা গরুকেই ক্রমাগত প্রেগন্যান্ট বানানো চলতেই থাকে, অবিরাম দুধের সাপ্লাই নিশ্চিত করার জন্য।
আর যখন সেই নির্যাতিত মায়ের শরীর থেকে আর দুধ পাওয়া যায় না কিংবা তার নির্ধারিত বয়স পার হয়ে যায়, তখন তাদের সোজা পাঠিয়ে সেয়া হয় কসাইখানায়।
বিস্তারিত জানতে আমেরিকার ডেইরি ইন্ডাস্ট্রির ওপর বানানো এই ভিডিওটা দেখে আসতে পারেনঃ
এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, আমাদের ব্যবহার করা অধিকাংশ দুধই এমন এক ইন্ডাস্ট্রি থেকে আসে, যেটাকে ইন্ডাস্ট্রি না বলে টর্চার সেল বলাটাই বেশি মানানসই।
আবার তার ওপরে এরা গ্রীন হাউজ গ্যাস ছড়িয়ে আমাদের পরিবেশেরও বারোটা বাজাচ্ছে।
এ তো গেল প্রাণীজ দুধের কথা, এর বিকল্প হিসেবে উদ্ভিদজাত দুধের ব্যাপারটা কেমন?
আসুন দেখে নেয়া যাক
প্রোটিন আর পুষ্টির লেভেল চিন্তা করলে শুধুমাত্র সয়ামিল্ক গরুর দুধের সাথে সমানে সমান পাল্লা দিতে পারে। অন্যদের বেলায় আর্টিফিশিয়াল হেল্প (প্রোটিন, ভিটামিন, আর ক্যালসিয়াম এড করা) লাগে তাদের গরুর দুধের সমান পুষ্টিকর বানাতে।
ভবিষ্যতে হয়তোবা গরুর দুধের আরো একটা বিকল্প আসতে চলেছে। অনেকগুলো উদ্যোক্তা কোম্পানী নন এনিমেল মিল্ক/ল্যাব মিল্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এই ল্যাব মিল্ক পুষ্টিতে বলেন, আর প্রোটিনে বলেন, হুবহু গরুর দুধের মতই।
এসব কোম্পানী জিন-মডিফায়েড ব্যাক্টেরিয়া আর ফারমেন্টেশনের মাধ্যমে এই অসাধ্য সাধন করেছে। এমনকি এই ল্যাবে বানানো দুধ থেকে চিজ/ পনীর পর্যন্ত বানানো সম্ভব, যেটা প্রাণীজ দুধ ছাড়া বানানো এতোদিন সম্ভব ছিলো না।
কারণ উদ্ভিদজাত দুধে “কেসিন (Casein)” আর “হোয়ে প্রোটিন (Whey Protein)” নামের দুটো উপাদান থাকে না। এই দুটো উপাদানই দুধ/পনীরের ইউনিক স্বাদ আর টেক্সচার এর জন্য দায়ী।
পরিবেশের ওপর প্রভাবের দিক দিয়েও ল্যাব মিল্ক আর উদ্ভিদজাত দুধ গরুর দুধের চেয়ে এগিয়ে। গরুর দুধের অনেক বিকল্পই গরুর দুধের চেয়ে অনেক কম জমি/পানি ব্যবহার করে আর অনেক কম পরিমানে গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে।
সুতরাং এটা বলা যায় যে, সব দিক দিয়েই এরা অলরাউন্ডার।
যদি আপনি পরিবেশের ওপর সবচেয়ে কম নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট রাখতে ইচ্ছুক হন, তাহলে আপনার সেরা চয়েজ হবে প্রাণীজ দুধের যে কোন একটা বিকল্প ব্যবহার করা। যেটাই আপনি হাতের কাছে পাবেন সেটাই ব্যবহার করতে পারেন।
এবার আসি শেষকথায়।
অন্যান্য যেকোন বিষয়ের মতই দুধের বিষয়টাও কমপ্লিকেটেড।
অধিকাংশ মানুষের জন্যেই এটা ক্ষতিকর না, বরং কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষের জন্য দুধ অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা পুষ্টিকর খাদ্য। কিন্তু এটা আবার আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর আর অনেক বর্বর/নিষ্ঠুর/অমানবিক একটা প্রসেসের ফল।
আমাদের আসলে সামাজিকভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা এই বিষয়গুলোকে কিভাবে মোকাবেলা করবো।
তবে হ্যা, দুধ না খাওয়ার সাথে আপনার ভালো/ খারাপ মানুষ হবার কোনই সম্পর্ক নেই।
সেটার জন্য একান্তই দায়ী আপনার কর্মকাণ্ড।
তথ্যসুত্রঃ
- Milk. White Poison or Healthy Drink? (youtube.com)
- Sources — Milk (google.com)
- Milk: Health benefits and nutrition (medicalnewstoday.com)
- PERSONAL HEALTH; Debate Over Milk: Time to Look at Facts — The New York Times (nytimes.com)
- Dairy products, calcium, and prostate cancer risk: a systematic review and meta-analysis of cohort studies — PubMed (nih.gov)
- Why Mammals are Called Mammals: Gender Politics in Eighteenth-Century Natural History on JSTOR
- Breastfeeding Is a Dynamic Biological Process — Not Simply a Meal at the Breast — PMC (nih.gov)
- Milk and dairy products in human nutrition (fao.org)
- Human Milk Composition: Nutrients and Bioactive Factors — PMC (nih.gov)
- Archaeology: The milk revolution | Nature
- Changing genes; losing lactase — PMC (nih.gov)
- Recent advances on lactose intolerance: Tolerance thresholds and currently available answers: Critical Reviews in Food Science and Nutrition: Vol 57, No 15 (tandfonline.com)
- Lactose malabsorption and intolerance: pathogenesis, diagnosis and treatment — PMC (nih.gov)
- Patterns of milk consumption and risk of cancer: Nutrition and Cancer: Vol 13, No 1–2 (tandfonline.com)
- Dairy products and pancreatic cancer risk: a pooled analysis of 14 cohort studies — PubMed (nih.gov)
- Milk consumption in relation to incidence of prostate, breast, colon, and rectal cancers: is there an independent effect? — PubMed (nih.gov)
- Milk, yogurt, and lactose intake and ovarian cancer risk: a meta-analysis — PubMed (nih.gov)
- Meat, fish, dairy and cancer risk — WCRF International
- Milk consumption and bladder cancer risk: a meta-analysis of published epidemiological studies — PubMed (nih.gov)
- (PDF) Colorectal Cancer and Nonfermented Milk, Solid Cheese, and Fermented Milk Consumption: A Systematic Review and Meta-Analysis of Prospective Studies (researchgate.net)
- Dairy products and colorectal cancer risk: a systematic review and meta-analysis of cohort studies — PubMed (nih.gov)
- Dairy consumption and gastric cancer risk: a meta-analysis of epidemiological studies — PubMed (nih.gov)
- Dairy consumption and risk of breast cancer: a meta-analysis of prospective cohort studies — PubMed (nih.gov)
- content (fao.org)
- Direct Agricultural Emissions — Big Facts (cgiar.org)
- American and German attitudes towards cow-calf separation on dairy farms — PMC (nih.gov)
- The Surprisingly Intolerant History of Milk | Smithsonian (smithsonianmag.com)
- Invited review: A systematic review of the effects of prolonged cow–calf contact on behavior, welfare, and productivity — ScienceDirect
- Reducing food’s environmental impacts through producers and consumers | Science
- Dairy Consumption and Risk of Stroke: A Systematic Review and Updated Dose–Response Meta‐Analysis of Prospective Cohort Studies | Journal of the American Heart Association (ahajournals.org)
Comments
Post a Comment