অতি সম্প্রতি আমাদের দেখা দিয়ে গেল আমাদের সৌরজগতের মহাকাশের অন্যতম উজ্জ্বল এক সদস্য।
ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০ বছরের মধ্যে যতগুলো ধূমকেতু দেখা যাবে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল হচ্ছে C/2024 G3 অ্যাটলাস নামের এই ধূমকেতু।
তবে সবচাইতে অবাক করা বিষয়টি হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে পরিচিত হ্যালির ধূমকেতুর মত এই ধূমকেতু কিন্তু ৭৬ বছর পর পর ফিরে আসে না।
সূর্যের চারদিকে নিজের কক্ষপথে একবার পুরোটা ঘুরে আসতে এই অ্যাটলাস ধূমকেতুর সময় লাগে দেড় লাখ বছরেরও বেশি সময়।
হ্যা, আপনি ঠিকই দেখছেন
C/2024 G3 অ্যাটলাস ধূমকেতু প্রতি ১ লাখ ৬০ হাজার বছর পর পর একবার করে পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান হয়।
চলুন দেখে নেয়া যাক বিস্তারিত।
এই C/2024 G3 ধূমকেতু সর্বপ্রথম আমাদের নজরে আসে গত বছরের (২০২৪) এপ্রিলে, আমাদের নাসা নিয়ন্ত্রিত মহাজাগতিক বস্তুর ওপর নজরদারী করা রোবট অ্যাটলাসের (Asteroid Terrestrial-impact Last Alert System - ATLAS) মাধ্যমে।
ফলে, ধূমকেতুটার নাম দেয়া হয় C/2024 G3 অ্যাটলাস
বিজ্ঞানীরা ধূমকেতুর কক্ষপথ গবেষণা করে বের করেছিলেন যে এই ধূমকেতু জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে সূর্যের খুব কাছ দিয়ে অতিক্রম করবে। এই সময়ে সূর্য থেকে ধূমকেতুটির দূরত্ব থাকবে ৯ মিলিয়ন মাইল বা ১৪ মিলিয়ন কিলোমিটারেরও কম।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে সূর্য থেকে তার সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধের (Mercury) মাঝখানের দুরত্বের মাত্র চারভাগের একভাগ দূরে থাকবে এই ধূমকেতুটি।
বিজ্ঞানীরা আরো গবেষণা করেছেন এই ধূমকেতুর আদি নিবাস নিয়ে। জানা গেছে, G3 অ্যাটলাস নামের এই ধূমকেতুর বাড়ি হচ্ছে আমাদের সৌরজগতের শেষের দিকে থাকা ওরট ক্লাউডে (Oort cloud), সূর্য থেকে প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন মাইল বা ১৬ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার দূরে।
ওরট ক্লাউড হচ্ছে এই ধূমকেতুর মতই অসংখ্য ধূমকেতুর বরফে ঢাকা নিউক্লিয়াস দিয়ে ভর্তি একটা বাবলের মত।
এই অসংখ্য নিউক্লিয়াস গঠিত হয়েছিল আমাদের সৌরজগতের জন্মের সময়, আর এরা সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের মতই সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে।
মাঝে মধ্যে এদের মধ্যে কেউ কেউ সূর্যের আকর্ষণে ছিটকে বের হয়ে রওনা দেয় সূর্যের দিকে, আর কাছাকাছি এসে সূর্যের তাপে এদের অধিকাংশই জ্বলে পুরে নিঃশেষ হয়ে যায় তাদের পেরিহেলিয়নে পৌঁছাবার আগেই।
কোন ধূমকেতুর পেরিহেলিয়ন (Perihelion) হচ্ছে সূর্য থেকে তার সম্ভাব্য সর্বনিম্ন দূরত্ব। আমাদের পৃথিবী তার পেরিহেলিয়নে পৌছায় জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে। তখন সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব সবচেয়ে কম থাকে।
নাসার নভোচারী ডন পেটিট আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন (ISS) থেকে পেরিহেলিওনে পৌঁছাবার আগেই C/2024 G3 ধূমকেতুর চমৎকার এক ছবি তুলে ফেলেন।
এতে দেখা যায় ধূমকেতুটি জলীয় বাষ্প আর ধূলা দিয়ে তৈরি উজ্জ্বল এক লেজ পেছনে রেখে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে সূর্যের দিকে।
গবেষনায় আরো জানা যায়, এই ধূমকেতুটি বয়সে বেশ প্রবীণ এবং আরো অন্তত একবার সে পৃথিবী ঘুরে গেছে।
শেষবার একে দেখা গিয়েছিল প্যালিওথিলিক পিরিয়ডের (Paleolithic period) প্রায় মাঝামাঝি সময়ে, যখন আমাদের পৃথিবীতে চলছিলো আইস এইজ (Ice Age), আর দুনিয়া কাঁপিয়ে বেড়াত আজকের দিনের হাতির পূর্বপুরুষ উলি ম্যামথেরা (Woolly Mammoth) ।
তবে কপাল খারাপ, ততদিনে মানব সভ্যতা এতোটা উন্নত হয় নি যে, সেই ঘটনা রেকর্ড করে রাখবে। আমাদের পূর্বপুরুষ তখন কেবলমাত্র আফ্রিকা মহাদেশ পেরিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে যেতে শুরু করেছিলো।
তারা ততদিনে চামড়া বা পাতা দিয়ে শরীর ঢেকে রাখতে, কিংবা পাথর দিয়ে যন্ত্রপাতি বানাতে শিখেছিলো ঠিকই, কিন্তু তাদের কাছে লেটেস্ট মডেলের আইফোন না থাকায় তাদের কেউ এই ধূমকেতুর ছবি তুলে রাখতে পারে নি।
তবে আমাদের কপাল খারাপই বলতে হবে। কারন, এই ধূমকেতুর বর্তমান গতিপথ শুধুমাত্র আমাদের দক্ষিন গোলার্ধ থেকেই খালি চোখে দেখা গেছে।
ধূমকেতুটির গতিপথের কারণে এর অবস্থান এমন জায়গায় হয়ে গেছে, যে তা উত্তর গোলার্ধে সকালে আর দক্ষিণ গোলার্ধে সন্ধ্যার সূর্যের আলোর নিচে হারিয়ে গেছে।
তবে তার থেকেও করুন ব্যাপার হচ্ছে ধারণা করা হয়েছিল এটাই খুব সম্ভবত আমাদের সাথে এই ধূমকেতুর শেষ সাক্ষাত। ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ ডাটাবেসের হিসেব অনুযায়ী, জানুরায়ীর ২ তারিখের হঠাৎ করেই G3 অ্যাটলাস ধূমকেতুর উজ্জ্বলতা প্রায় চার গুণ বেড়ে যায়।
স্পেস ডট কমের বরাত দিয়ে ধূমকেতু গবেষক জন বরটল (John Bortle) জানান, এটি একটা বাজে লক্ষণ।
এই রকম অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা সাধারণত কেবলমাত্র তখনই দেখা যায়, যখন সূর্যের খুব কাছাকাছি থাকার কারণে ধূমকেতুটি অতিরিক্ত তাপ আর বিকিরণের প্রভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া শুরু করে।
G3 অ্যাটলাস ধূমকেতুর জন্য পেরিহেলিওনের পরিমাপ হচ্ছে সূর্য থেকে প্রায় ৮৭ লাখ মাইল বা প্রায় ১৪ লাখ কিলোমিটার।
জানুয়ারির ১৩ তারিখে ধূমকেতুটি সেই দুরত্বে পৌছায়। ওই একই দিনে ধূমকেতুটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি দূরত্বে আসে, যার পরিমান ছিল প্রায় ৮৭ মিলিয়ন মাইল না ১৪০ মিলিয়ন কিলোমিটার।
তাই জানুয়ারির ১৩ তারিখেই ধূমকেতুটি সবথেকে উজ্জ্বল হয়েছিল। কিন্ত সূর্যের সাপেক্ষে তার অবস্থানের কারণে তাকে খালি চোখে দেখা প্রায় অসম্ভবই ছিলো বলা চলে।
কিন্তু মহাকাশ পাগল মানুষকে কি এতো সহজে দমিয়ে রাখা যায়?
গোটা পৃথিবীর নানা প্রান্তেই মানুষ চেষ্টা করে গেছে জীবনে একবারই পাওয়া এই অমূল্য সুযোগের সদ্ব্যবহার করার।
ফটোগ্রাফার জশ ডুরি (Josh Dury) সূর্যাস্তের পরপরই নিচের ছবিটি তুলতে সক্ষম হয়েছেন। ছবি তোলার কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় ধূমকেতুটি।
তবে খালি চোখে পৃথিবীতে বসে দেখতে পাওয়া ধূমকেতুটির সবচেয়ে পরিষ্কার ছবিটা পাওয়া গেছে আর্জেন্টিনা থেকে। পৃথিবীর আনাচে কানাচে থেকে C/2024 G3 অ্যাটলাস ধূমকেতুর তোলা বিভিন্ন ছবি দেখুন এখানে।
সবশেষ এমন উজ্জ্বল ধূমকেতুর দেখা আমরা পেয়েছিলাম গত বছরের অক্টোবরে, যখন C/2023 A3 (Tsuchinshan-ATLAS) নামের আরেকটি ধূমকেতু আমাদের পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
৮০ হাজার বছর পর পর ফিরে আসা এই ধূমকেতুর গল্প না হয় আরেকদিন হবে।
সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, G3 অ্যাটলাস ধূমকেতুটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ঘুরে এসেছে আর রওনা দিয়ে দিয়েছে তার বাড়ির দিকে ১৪ তারিখ থেকে ২৬ তারিখের মধ্যে আস্তে আস্তে কমে আসছে তার উজ্জ্বলতা।
আর কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের দৃষ্টিসীমা থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যাবে C/2024 G3 অ্যাটলাস
তবে আশঙ্কার কথা হচ্ছে, যেসব ধূমকেতু সূর্যের এতো কাছাকাছি চলে যায়, তাদের অধিকাংশই আর ফিরে আসে না। ধূমকেতু সাধারণত গঠিত হয় পাথর, বিভিন্ন ধাতুর মিশ্রন, আর বরফ দিয়ে। এরা গ্র্যাভিটির আকর্ষণে পরস্পরের সাথে আটকে থাকে।
নিশ্চয়ই ভাবছেন, তাহলে ধূমকেতুকে এতো উজ্জ্বল দেখায় কেন?
আসল কাহিনী হচ্ছে, সূর্যের যত কাছাকাছি যাওয়া যায়, তাপ আর বিকিরণের প্রভাবে গ্র্যাভিটি আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকে।
ধূমকেতুর ভেতরে থাকা বরফ পরিণত হয় জলীয় বাষ্পে, আর পাথর এবং ধাতু ক্ষয়ে গিয়ে পরিণত হয় ধুলায়। এই ধূলা আর জলীয় বাষ্পের মেঘকে বলা হয় কোমা (Coma)।
এই কোমার মধ্যে সূর্যের আলো পড়লে তা সেই উজ্জ্বল আলো চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়, আর আমরা ধূমকেতুটাকে দেখতে পাই।
গবেষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে গিয়েছিল যখন হাঙ্গেরির এস্ট্রো ফটোগ্রাফার লিওনেল মাইজিক (Lionel Majzik) চিলিতে বসে C/2024 G3 অ্যাটলাস ধূমকেতুর ছবি তোলেন।
জানুয়ারির ১৮ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত একটানা তোলা সেই ছবিগুলোতে দেখা যায়, ধূমকেতুটির লেজ ক্রমে প্রশস্ত আর উজ্জ্বল হচ্ছে, এবং এর নিউক্লিয়াস বা কোর ঝাপসা হয়ে আসছে।
ব্রিটিশ এস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনের ধূমকেতু গবেষক রিচারড মাইলস (Richard Miles) অবশ্য মনে করছেন, বোধহয় ধূমকেতুটি মৃত্যুর কাছাকাছি এই অভিজ্ঞতা থেকে এই যাত্রায় বেঁচে গেছে, যদিও এই নিয়ে আরো বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন।
ব্রিটিশ এস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন থেকে আরেক ধূমকেতু পর্যবেক্ষক নিক জেমস (Nick James) জানিয়েছেন,
“শুরুতে হঠাৎ করে ধূমকেতুর উজ্জ্বলতা বেড়ে যাওয়াতে ধারণা করা হয়েছিলো সেটা ধূমকেতু ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবার একটা লক্ষণ।
কিন্তু তার পর থেকে ধূমকেতুটির উজ্জ্বলতা কমে না গিয়ে বরং খানিকটা বেড়েছে। সুতরাং মনে হচ্ছে সূর্যের সাথে এবারের এই সাক্ষাত C/2024 G3 অ্যাটলাস ধূমকেতুটির জন্য প্রাণঘাতি হবে না। ”
এই C/2024 G3 অ্যাটলাস ধূমকেতুটি নানা কারণে নভোবিজ্ঞানীদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এই ধূমকেতু থেকে পাওয়া আলো বিশ্লেষণ করে তারা আমাদের সৌরজগতের গঠন হবার সময়ের তথ্য পাবেন।
যখনি এসব ধূমকেতু সূর্যের কাছে আসে, তখন সূর্যের তাপ আর গ্র্যাভিটির প্রভাবে তা ভেঙ্গে পড়ে, আর সেই ঘটনা থেকে আমরা এমন সব তথ্য পাই, যা সৌরজগতের কিভাবে গঠিত হয়েছিল, সেই সম্পর্কে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়।
যদিও আমাদের পৃথিবীর আকাশে C/2024 G3 অ্যাটলাস ধূমকেতুটি মে মাস পর্যন্ত থাকবে, তবে সূর্যের সাথে দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে তার উজ্জ্বলতাও কমতে থাকবে।
তাই খালি চোখে ধূমকেতুটি জানুয়ারী মাসের পর থেকে আর দেখা যাবে না। তার জন্য দরকার হবে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্রপাতি।
তথ্যসুত্রঃ
- Once-in-a-160000-year comet G3 ATLAS could shine as bright as Venus next week. Here's what to expect. | Space
- Photographer captures rare Comet G3 ATLAS from UK in dramatic 'once-in-a-lifetime' image | Space
- Comet ATLAS C/2024 G3 falls apart after rare encounter with the Sun | Fox Weather
- Comet C/2024 G3 ATLAS' 'near-death encounter' with the sun may have blown it apart, new photos suggest | Live Science
- 'Totally amazing' astronaut photo captures comet C/2024 G3 ATLAS shooting past Earth from the ISS | Live Science
- Is super-bright Comet ATLAS G3 disintegrating?
- Rare comet may be visible for only time in 160,000 years
- Comet ATLAS G3 in the sunset’s glow: Pics here!
- Rare illusion gives 'once-in-a-lifetime' comet a seemingly impossible 2nd tail after closest approach to Earth for 80,000 years | Live Science
- An Evolutionary Timeline of Homo Sapiens | Smithsonian
Comments
Post a Comment